বিয়ের পর থেকেই লাভলীর মনে একটা মেয়ে সন্তান হবার স্বপ্ন খুব করে দানা বেঁধেছিল । ছোট্ট একটা মানুষ সারাদিন তার ঘরময় ছোট পায়ের ছাপ ফেলে হেঁটে বেড়াবে , খুব মিষ্টি হবে দেখতে তার মুখশ্রী । বড় দু’খানা চোখ আর তাতে থাকবে রাজ্যের মায়া । তার আলোয় ঝলমল করবে লlভলীর সমস্ত ঘর দুয়ার ।
সত্যিকারের দোয়া কখনও বিফলে যায় না বলে , যেদিন সে জানতে পারে তার মেয়ে হবে , আনন্দে ঝলমল করে উঠে তার মুখ । সত্যিই একদিন তার কোল জুড়ে এলো একটা মিষ্টি মেয়ে । তার নাম রাখা হয় জান্নাতুল ফেরদৌস প্রাপ্তি, যে ঘুমালে ঘর আলোতে ভরে যায় । ছোট্ট নরম দু’খানা হাত , হালকা ঝলমলে চুল , কাছে গিয়ে চুমু খেলেই ,গা থেকে বের হয় পাউডারের মৃদু গন্ধ। কখনও ঘুমে সে ঠোঁট উলটে কাঁদে ,কখনও হাসে ,পাশে বসে সব দেখে লাভলী । মেয়ের উপর থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না তার । ছোট্ট বাসায় স্বামী , শাশুড়ি আর মেয়েকে পেয়ে তার সুখ যেন উপচে পড়ে । মাঝে মাঝে অবশ্য ভয় হয় । এতো সুখ তার সইবে তো !
স্বামী বাড়ি ফিরলে দারুণ এক অনুভূতি হয় লাভলীর । এমন একটা মানুষকে পেয়ে তার জীবন যেন ষোল আনায় পূর্ণ । একেবারেই সাধারণ আর সহজ-সরল একজন মানুষ । কোন অহংকার নেই পলাশের , খুব দায়িত্বশীল আর সচেতন তবে নিজের দিকে কোন খেয়াল নেই তার । পরিবার কি করে ভাল থাকবে ,সব খেয়াল যেন সেদিকে ।
পলাশ বাড়ি ফিরলে লাভলীর ব্যস্ততা বাড়ে । জলদি চুলা জ্বালিয়ে সে চায়ের কেটলি চাপায় । চায়ের পাশে বিস্কুট সাজিয়ে স্বামীর দিকে নিয়ে গেলে ,খবরের কাগজে চোখ বুলানোর ফাঁকে, চোরা চোখে কিছুক্ষণ লাভলীকে দেখে নেয় পলাশ । বড় মিষ্টি দেখতে তার বউ । বড় দু’খানা চোখ আর হাসিতে যেন ঠাসা মায়া । খোঁপা ছাড়লে ঘন কালো চুল গড়িয়ে একদম পিঠ ছাড়িয়ে যায় । খুব ভাল মেয়ে লাভলী। তার মা আর সংসারকে খুব যত্নে আগলে রাখছে । পলাশ খুব কম কথা বলা মানুষ । মনের অনেক অনুভূতি কথায় প্রকাশ করতে পারে না । তবে মাঝে মাঝে কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে, বউয়ের জন্য টিপের একটা পাতা প্যান্টের পকেটে করে আনতে সে ভুল করে না । এমন ছোট্ট উপহার পেয়ে লাভলীর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি জমে উঠে । পলাশের দেয়া ছোট ছোট সুখ গুলোই তাকে খুব সুখী করে কারণ পলাশকে সে খুব ভালবাসে ।
প্রাপ্তি দেখতে হয়েছে একদম মায়ের মতো । ডাগর এক জোড়া চোখ আর মায়ায় লেপটে থাকা এক মায়াবী চেহারা । সারাদিন সে মায়ের সাথে ঘুরে ফিরে । ছোট পায়ে এ ঘর থেকে ও ঘরে যায় । তবে পলাশ বাড়ি ফিরলে লাভলীর মতো মেয়ের ও ব্যস্ততা বাড়ে । ছোট পায়ে বাবার দিকে সে দৌড়ে আসে । বাবার ক্লান্ত চেহারা তাকে ভাবায় । মাকে বাবার জন্য জলদি চা করতে বলে । বাবাকে কখনও এটা ওটা এগিয়ে দেয় । মেয়ের কাণ্ড দেখে পলাশ ক্লান্তহাসে ।
মেয়ে হবার পর থেকে পলাশের মন অন্য রকম ভাল থাকে । মেয়ের মুখ দেখলে ভিতরে ভিতরে তার আনন্দ উপচে পড়ে । এক বাবার এক ছেলে পলাশ । ছোটবেলা থেকেই একা মানুষ হয়েছে । ভাই বোনের আদর ভালবাসা তার পাওয়া হয়নি । তাই মেয়ে কে পেয়ে পলাশ একেবারে আনন্দে দিশেহারা ।
দেখতে দেখতে মেয়ের বয়স তিনের কোটায় পা দিল । সারাদিন একা তার একটু একঘেয়ে লাগে বলে তাকে একদিন স্কুলে প্লে তে ভর্তি করানো হল । স্কুলে গিয়ে প্রাপ্তি মহা খুশি ! তার মতো আরও অনেকের সাথে সে কথা বলতে পারে, খেলতে পারে । এখন আর তার আগের মতো একা লাগে না ।
আজও প্রতিদিনকার মতো পিঠে ছোট ব্যাগ চাপিয়ে মায়ের সাথে প্রাপ্তি স্কুলে গেল । চারদিকে অভিভাবক আর বাচ্চাদের আনাগোনা । স্কুলের মাঠে আজ ২১ ফেব্রুয়ারীর র্যালি চলছে । প্রাপ্তি ও র্যালিতে গিয়ে দাঁড়াল।
আরোও পড়তে পারেন- নদীর আঁচল ।। আলিফ আলম
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কেউ এসে লাভলীকে খানিকটা অস্থির স্বরে বলল , র্যালিতে হাঁটতে গিয়ে প্রাপ্তি পড়ে গিয়েছে । যান , দেখে আসুন । সব অভিভাবকরা র্যালি থেকে একটু দূরে হাঁটছিল । কথাটা শুনে লাভলী তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে র্যালির সামনের দিকটায় এসে দেখে মেয়ের কাপড়ে ময়লা লেগে আছে ।
____ কি ব্যাপার আম্মু ? পড়ে গেলে যে । ব্যথা পেয়েছ ? তার জামার ধুলো-বালি ঝাড়তে ঝাড়তে লাভলী কথাটা জিজ্ঞেস করল ।
____ একটু ব্যথা পেয়েছি, আম্মু । তবে এখন ঠিক আছি ।
সেদিন বাড়ি ফিরে সব ঠিকঠাক । কোন অসুবিধা নেই । পড়ে যাওয়া বিষয়টা লাভলী একদম পাত্তা দেয়নি । র্যালিতে কত বাচ্চার একসাথে হাঁটতে হয় । কারো ধাক্কা লেগেও অন্য বাচ্চা পড়ে যেতে পারে । তবে পলাশ বাড়ি ফিরলে চা খেতে খেতে হঠাৎ কথাটা বলে ফেলল লাভলী ।
____ জানো , আজ না প্রাপ্তি র্যালিতে পড়ে গিয়েছিল ।
পলাশ চকিত চোখ তুলে বলল , তাই ! ব্যথা পায়নি তো !
____ না , তেমন ব্যথা পায়নি শুধু কাপড়টা ময়লা হয়েছে ।
মুড়মুড়ে টোস্ট আর দুধ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পলাশ খবরের পাতায় মন দিল । প্রাপ্তি দেখতে খুব মিষ্টি হয়েছে । বেশ ভরাট চেহারা আর ভাল স্বাস্থ্য ওর । জন্মের পর থেকে তার তেমন অসুখ হয় নি। কিন্তু কেন পড়ে গেল , এই ভাবনাটা পলাশের মাথায় রয়ে গেল ।
এর কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন অস্ফুট স্বরে লাভলী প্রাপ্তিকে বলতে শুনল ,
____ আম্মু , আমার পায়ে ব্যথা । হাঁটতে পারছি না ।
মেয়ের কথা শুনে পরদিনেই পলাশ প্রাপ্তিকে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে গেল । হঠাৎ মেয়ের পায়ে কেন ব্যথা হবে । এ তো মোটেও ভাল কথা নয় । মেয়ের হাঁটতে কষ্ট হবে বলে কোলে নিয়ে পলাশ হাঁটছে আর ভাবছে । আজ রাজ্যের ভিড় ডাক্তার খানায় । লম্বা সিরিয়াল তার । অনেকক্ষন পর তার ডাক পড়ল । ডাক্তার দেখে তেমন কিছু না বলে, কিছু ক্যালসিয়াম লিখে দিলেন আর বললেন , বাচ্চারা বড় হতে শুরু করলে তাদের হাড়ে এক ধরণের ব্যথা হয় , যাকে আমরা গ্রয়িং পেইন বলি । এটা নিয়ে ভাববেন না । এমনটা অনেকের হয় ।
ডাক্তারের কথা শুনে পলাশ সেদিন ভাবনাহীন ভাবে বাড়ি ফিরল ।
প্রাপ্তি এই বয়সে বেশ গোছানো আর পরিচ্ছন , খুব লক্ষ্মী আর শান্ত মেয়ে । বাবা মাকে একদম বিরক্ত করে না । একদিন হঠাৎ কি করে যেন সে বিছানা নষ্ট করে দিল ।
____ আম্মু , আমি বিছানায় প্রস্রাব করে দিয়েছি । মেয়ের কথা শুনে লাভলী তো অবাক ! মেয়ে তার এমন পরিপাটি , সে কিনা বিছানা নষ্ট করে দিয়েছে !
____ কাছেই তো বাথরুম , তুমি নামলে না কেন ?
____ আমার পায়ে ব্যথা । আমি হাঁটতে পারি না ।
____ কি বলো এ সব !
কথায় মায়ের ধমকের সুর শুনে মেয়ে কেঁদে দিল । এক পর্যায়ে ব্যথার সাথে তার কান্না ও বেড়ে যায় ।
প্রাপ্তির এমন সজোরে কান্না শুনে পাশের ঘর থেকে দাদী দৌড়ে এলো ।
____ কি হয়েছে তোমার দাদু ?
____ আমার পায়ে খুব ব্যথা । আমি হাঁটতে পারছি না ।
এরপর থেকে কি যে হল মেয়ের, ব্যথার ভয়ে আর হাঁটে না । এক রুম থেকে অন্য রুমে গেলে হামাগুড়ি দিয়ে যায় । প্রাপ্তির এ অবস্থা দেখে, এবার সবাই ভয় পেয়ে যায় । দুশ্চিন্তায় লাভলীর হাত পা শুকিয়ে আসে । কি হল তার মেয়ের ! অনেক জায়গায় অনেক ডাক্তার দেখানোর পরেও কেউ কোন সমস্যা ধরতে পারলো না। সব ডাক্তারদের এক কথা , এটা তেমন কিছু না । ভয় পাবার কোন কারণ নেই । কিছু ক্যালসিয়াম লিখে দিয়ে ,সাতদিন পর আবার দেখা করতে বলে । অনেকে আবার বলে হাড়ের সমস্যা । ছয় মাস একটানা ঔষধ খাওয়াতে হবে , একদিন ও বাদ দেয়া যাবে না ।
একদিন ও ঔষধ বাদ দেয়া যাবে না , বিষয়টা লাভলীকে খুব ভাবিয়ে তুলল । এতো ছোট মেয়ের কি এমন হয়েছে ? কেনই বা সে হাঁটতে ভয় পায় ? প্রাপ্তির কথা শুনে অনেকে তাকে দেখতে আসে । মেয়ের জন্য লাভলী মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়েছে । কেউ তাকে সান্ত্বনা দিলে, লাভলী শুধু একটা কথাই বলে , আমার মেয়ের আর যাই হোক তার যেন খারাপ কিছু না হয় ।
এদিকে লাভলীর শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে । পেটে বাচ্চা আসলেই তার খুব বমি শুরু হয় । কিছু খেতে পারে না । খাবার পর পরেই বমির ভাব হয় বলে, বমির পর পেট খালি হয়ে যায় । দুর্বল শরীর আরও নিস্তেজ হয়ে পড়ে । কখন ও গা পাকিয়ে হাত-পা শিরশির করে । রাতে ভাল ঘুম হয় না । এমন শরীর নিয়ে মেয়েকে দেখাশুনা করাটা , তার জন্য খুব কষ্টের হয়ে যাচ্ছে । তাই সে ভেবে দেখেছে যে তার বাবার বাড়ি চলে গেলে ভাল হয় ।
তাই মেয়ের স্কুল বন্ধ করে তাকে নিয়ে একদিন লাভলী বাবার বাড়ি চলে গেল । এমন শরীর খারাপেও মেয়েকে নিয়ে হাজারও দুশ্চিন্তা এসে কারণে-অকারণে তার মনে ভিড় জমায় । এদিকে মেয়েকে হাড়ের সমস্যার নিয়মিত ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে কিন্তু ব্যথা তেমন সারছে না । লাভলীর মাঝে এবার সত্যিই দুশ্চিন্তা দানা বেঁধে উঠল । কিছুতেই সে মনে স্বস্তি পাচ্ছে না । তাই সে সিদ্ধান্ত নিল ঢাকায় এসে অনেক বড় হাড়ের ডাক্তার দেখাবে মেয়েকে । এত জনকে দেখিয়ে ও কোন লাভ হয় নি । কেউ তেমন করে মেয়ের সমস্যাটাই ধরতে পারল না ।
কিছুদিন পর লাভলী তার দুর্বল আর ক্লান্ত শরীর নিয়েও মেয়েকে নিয়ে ঢাকা ফিরে এল । আগের সব রিপোর্ট সহ পলাশকে একদিন দেশের বড় এক হাড়ের ডাক্তারের কাছে পাঠাল । ডাক্তার সাহেব প্রাপ্তির এক্সরে রিপোর্ট দেখে প্রথমে চমকে উঠলেন ! উনি পলাশের সাথে আলাদা ভাবে কথা বলতে চাইলেন ।
ডাক্তার সাহেবের রুমে বসে পলাশের এক পলকে চারপাশটা আনমনে চোখে পড়ল । দেয়ালের নানা জায়গা জুড়ে হাড়ের বিভিন্ন ছবি ঝুলানো । বা দিকে একটা কালো বিছানা পাতা । ডাক্তার সাহেব বিশাল বড় টেবিলে গম্ভীর মুখে প্রাপ্তির রিপোর্টে চোখ ডুবিয়ে , ব্রু কুঁচকে খুব ভালভাবে সব খুঁটিনাটি দেখছে । পলাশ লক্ষ্য করছে ডাক্তার সাহেবের কপালের রেখা গুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ।
____ হঠাৎ পলাশের দিকে চিন্তিত চোখ তুলে বলল , প্রাপ্তি আপনার কে হয় ?
____ পলাশের ঝটপট উত্তর , আমার মেয়ে ।
____ দেখুন পলাশ সাহেব , আমি এতক্ষণ যা দেখলাম তাতে ভাল কিছু আমার চোখে পড়েনি ।
কথাটা শুনে বুকের ভিতরটা কেমন যেন ধক করে উঠল পলাশের ।
____ কি হয়েছে আমার মেয়ের ? পলাশ খুব সহজ ভাবে জানতে চাইল ।
____ ওর ব্লাড ক্যান্সার !
পলাশ টের পাচ্ছিল তার হাত পা কাঁপছে । বুকের ভিতর একটা বিশাল বড় দুঃখের ঢেউ এসে যেন জোরে ধাক্কা দিয়ে গেল ।
খুব অসহায় ভাবে জানতে চাইল পলাশ ,
____ এটা কি করে হল আমার মেয়ের ?
____ আসলে ব্লাড ক্যান্সার অধিকাংশ সময় শিশুদেরই হয়ে থাকে । আপনি হয়ত জেনে থাকবেন আমাদের রক্তে দুই ধরণের রক্ত কণিকা থাকে । এক হল লাল রক্ত কণিকা আর অপরটি সাদা রক্ত কণিকা । এই সাদা রক্ত কণিকা যখন লাল রক্ত কণিকার চেয়ে পরিমাণে বেড়ে যায় ,তাকেই আমরা লিকুমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সার বলি যা আপনার মেয়ের হয়েছে ।
____ তাহলে তার পায়ে কেন ব্যাথা হচ্ছে ?
____ আসলে অস্থিমজ্জাতেই আমাদের রক্ত উৎপন্ন হয় । ব্যথা হবার পেছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে । তবে এই রোগটা ধরতে কেন ডাক্তারদের এতো সময় লাগল , তা ঠিক বুঝতে পারলাম না । যদিও কিছুটা দেরি হয়ে গেছে তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের চিকিৎসা শুরু করতে হবে । নইলে বিপদ বাড়বে ।
ডাক্তার সাহেব নিচু হয়ে কাগজ উল্টাতে উল্টাতে পলাশের দিকে আরও একবার চেয়ে বলল , ভেঙ্গে পড়বেন না । আমি বুঝতে পারছি আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে । আপনি চাইলে বাইরেও চিকিৎসা করাতে পারেন । তবে দেশেও এখন বাইরের মতো একেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে । জলদি চিকিৎসা শুরু করুন । সঠিক চিকিৎসা পেলে আপনার মেয়ে সেরে উঠবে । আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন আর আমরা তো রয়েছি । এমনিতেই কিছুটা সময় চলে গেছে । রোগটা আগে ধরা পড়লে , অনেক আগেই আমরা চিকিৎসা শুরু করতে পারতাম।
পলাশ বাড়ি ফিরে সেদিন কাউকে কিছু বলেনি । লাভলী বারবার তার কাছ থেকে ডাক্তার কি বলেছে জানতে চেয়েছে । সে খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তরে দিয়েছে ,ভয়ের কিছু নেই । তেমন কিছু না । এত ভেবো না তো । এমনিতেই ভেবে ভেবে তোমার শরীর অনেক খারাপ করেছে ।
সেদিন পলাশ সারাদিন খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল । অনেকদিন পর কবিতার বইগুলো চা খেতে খতে উল্টে পাল্টে দেখল । কতকাল তার কবিতা আবৃত্তি করা হয় না । একসময় তার ভরাট গলায় কবিতারা দারুণ এক প্রাণ পেত। সেদিন রাতে ভাল খায়নি পলাশ । সারারাত অস্থির ভাবে সবার চোখের আড়ালে পায়চারি করেছে । নানা অস্পষ্ট চিন্তা ,ভয় আর স্বপ্ন তার মাথায় ঘুলিয়ে উঠল । এমনিতেই কম কথা বলা মানুষ সে । বাবা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডি জি এম কিন্তু কোনদিন এ নিয়ে তার অহংকার হয়নি । মারা যাবার আগে বাবা খুব অসুস্থ হয়ে গেলেন । বাবার জন্য সে কোন কিছু কমতি করেনি । মানুষকে ভালবাসতেই সে ভালবাসে । ভাই বোনের আদর ভালবাসা তার পাওয়া হয়নি । মেয়ে হবার পর , মেয়ের ভালবাসা পেয়ে সে তার সব দুঃখ ভুলে গিয়েছিল । কিন্তু কে জানত নিয়তি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে বলে নিরবে জীবনের সাথে চুক্তি করে ফেলেছে ।
আজকাল পলাশের একদম রাতে ঘুম হয় না । রাত হলেই হাজারো চিন্তা তাকে চেপে ধরে । অস্থির হয়ে এপাশ ওপাশ করেই রাত কেটে যায় । বাইরে মানুষের কথাবার্তা , সাইকেল , রিক্সার শব্দ সব তার কানে আসে । দুশ্চিন্তায় বুকের ভিতর কেমন যেন ধুক ধুক করে । লাভলীর শরীরের যা অবস্থা, তাকে কি করে এই খবর দিবে পলাশ ! আর লাভলী কি করে এসব সহ্য করবে ! তাছাড়া এমনিতেই রোগ ধরতে দেরি হয়ে গেছে । খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করতে হবে । সবাইকে তো বিষয়টা একদিন জানাতেই হবে । এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ভোরের আলো এসে দরজা জানালায় কড়া নাড়ে, পলাশ তা টেরই পায় না । কিন্তু দিনের বেলা সবার সামনে তার চলাফেরায় থাকে এক নিশ্চিন্ত ভাবভঙ্গি ।
মেয়ের এমন অসুখের খবর যেন এক নিমিষে তার জীবনের সব রঙ বদলে দিয়েছে । এদিকে তার ঘর আলো করে আসার জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন আর এক শিশু । আজকাল শারীরিক অবসাদ আর মানসিক দুশ্চিন্তায় পলাশের শরীর খুব দুর্বল লাগে । হাঁটতে গেলে পা ভেঙ্গে যায় । সে ভেবে পায় না কেন তার জীবনে হঠাৎ এমন ঝড় এল। নিজেকে খুব অসহায় আর একা লাগে তার । মেয়েটাকে দেখলেই তার চোখ ভিজে উঠে । এমন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে তার । কি করে হল এমন !
একদিন লাভলীকে বেশ সাহস করেই প্রাপ্তির বিষয়টা জানায় পলাশ । মেয়ের কথা শুনে লাভলীর খারাপ শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়ে । কোন ভাবেই তার কান্না থামানো যায় না । কিন্তু না বলেও তো উপায় নেই । কতদিন সে এমন কথা লুকিয়ে রাখবে ? তাছাড়া খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসা ও শুরু করতে হবে ।
অবশেষে ২০১৫ সালের ১০ এপ্রিল প্রাপ্তিকে পি জি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । ওখানেই তার চিকিৎসা শুরু হয় । একবার পলাশ ভেবেছিল প্রাপ্তিকে ভারতে নিয়ে যাবে কিন্তু লাভলীর শরীরের এমন অবস্থায় তার পক্ষে এই মুহূর্তে বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না । মোট তিন বছর ৬ মাস চিকিৎসা চলবে । বই আকারে একটা প্রটোকল হাতে পেয়ে নিজেদের কিছুটা শক্ত করল লাভলী । সঠিক চিকিৎসা পেলে তার মেয়ে একদিন সেরে উঠবে ।
তাই প্রতিদিন দুই বেলা করে মাউথ ওয়াশ দিয়ে কুল্কুচি করা , দুই বেলা নাকের ড্রপ আর দুই বেলা করে গরম পানিতে এক বিশেষ ঔষধ দিয়ে , বাইরে পা দু খানা বের করে কোমর পর্যন্ত প্রাপ্তিকে ডুবিয়ে রাখতে হবে। আর প্রতি মাসে একবার করে ‘ক্যানোলা’ করাতে হবে । আর একটা থেরাপি প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর দিতে হবে যা মেরুদণ্ডে ইঞ্জেকশান দিয়ে করতে হবে ।
এভাবেই তার চিকিৎসা শুরু হল । প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হলেও পরে প্রাপ্তি বাবা মায়ের মতো নিজেই সব বুঝে গেল । সে জানে কখন তার কি কি করতে হবে । বাবা মায়ের মতো সে ও ধীরে ধীরে তার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠল ।
একে তো বাচ্চা মানুষ । প্রতিদিন এতোবার করে মাউথ ওয়াশ আর ১৫ -২০ মিনিট কোমর ডুবিয়ে পানিতে বসে থাকতে তার ভাল লাগে না । তবুও সে বুঝে গেছে তার একটা বড় অসুখ হয়েছে । একদিন সে ভাল হয়ে যাবে । বাইরের খাবার খাওয়া তার নিষেধ । তবে মা বলেছে , ভাল হলে সে সব খেতে পারবে । তার নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে , রোগটা একদিন সেরে গেলে, সে বাবা মায়ের সাথে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়াবে । মাঝে মাঝে হাসপাতাল থেকে দেয়া বইটা উলতে পালতে দেখে প্রাপ্তি । সেখানে সব নিয়ম কানুন দেয়া আছে । কি কি তার করা যাবে , কি কি করা যাবে না । আর কোন কোন মাসে তাকে কোন থেরাপি নিতে হবে ইত্যাদি । সে এসবের সব জানে ।
তার সব ভাল লাগে কেবল থেরাপি ছাড়া । ক্যানোলা করার সময় হাতের অথবা পায়ের শিরা দিয়ে ইনজেকশন নিতে হয় । এটা করার সময় প্রায়েই প্রাপ্তির শরীর ফুলে যায় । শিরা সহজে পাওয়া যায় না বলে অনেকবার তার শরীরে সুচ ফুটাতে হয় । আর আই. টি থেরাপিকে তার ভয়ংকর মনে হয় । বাবা মাকে তার পাশে থাকতে দেয় না । তখন তার খুব ভয় হয় । এতো টুকুন একটা মানুষ সে, ভয় হবে না ! থেরাপির পর বাবা মায়ের প্রতি তার খুব অভিমান হয় । কেন তারা এমন করে তাকে কষ্ট দেয় ।
আই. টি থেরাপির জন্য প্রাপ্তিকে কখনও কখনও অনেক বুঝিয়ে হাসপাতালে নিতে হয় । নার্সরাও একপ্রকার জোর করে প্রাপ্তিকে কেড়ে নিয়ে যায় । যাবার সময় প্রাপ্তি মাকে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে থাকে , কান্নাকাটি করে । তারপর দরজার বাইরে পলাশ আর লাভলীর স্মান চোখে নিথর হয়ে বসে থাকাটা একপ্রকার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে । ভিতর থেকে মেয়ের কান্না আর চিৎকার তাদের কানে আসতেই বুকের ভিতর দুঃখেরা যেন গুমরে উঠে ।
আই .টি করার পর এক ঘণ্টা বালিশের উপর উপুড় করে শুইয়ে ধরে রাখতে হয় । এই থেরাপি তিন মাস অন্তর অন্তর দিতে হয় । প্রথমে মেরুদণ্ড থেকে রক্ত নিয়ে, পরে একেই সাথে ওখানে তিনটি ইঞ্জেকশান দেওয়া হয় । এই থেরাপির পরেই প্রাপ্তি খুব দুর্বল হয়ে যায় । প্রচণ্ড জ্বরে মানুষ যেমন ক্লান্ত থাকে ঠিক তেমন । মুখে খাবারের স্বাদ থাকে না , জোর করে খাওয়াতে হয়। চেহারায় ক্লান্তির ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠে । পুরো সাত দিন এমন যায় । লাভলী ও হাল ছাড়ে না । যে করেই হোক প্রাপ্তির শরীরটাকে ভাল রাখতে হবে । রক্তের রিপোর্ট খারাপ আসলে তাকে পরের থেরাপি দেয়া যাবে না ।
লাভলী এমনি খুব দুর্বল মানুষ । রক্ত ,কাঁটা ছেঁড়া দেখলে তার ভয় হয় । তবু ও প্রতি থেরাপির আগে সে মন কে শক্ত করে । কখনও খুব কাঁদে , মানসিক ভাবে ভেঙ্গে যায় , আবার উঠে দাঁড়ায় । মেয়েকে সে বড্ড বেশি ভালবাসে । থেরাপির আগেই লাভলী বাড়ির সব কাজ গুছিয়ে রাখে । সে জানে মেয়েকে তার অনেক সময় দিতে হবে । বিছানার পাশে বসে মেয়ের কপালে মাথা ঠেকিয়ে কথা বলতে বলতে, মা মেয়ের বিষণ্ণ সময় গুলো কেটে যায় । প্রাপ্তির ঝলমলে চুলে বিলি কাটতে কাটতে লাভলী বলে , এই তো আর কটা দিন, আম্মু । তারপর আর চিন্তা নেই । এখন পর্যন্ত সব ভাল আছে তোমার । আর একটু কষ্ট করতে হবে তোমাকে । অসুখটা যে বড্ড শক্ত ! এরপর তোমাকে আমরা থেরাপি দিয়ে আর কষ্ট দিব না । কিন্তু প্রাপ্তি মায়ের উলটো , সে খুব শক্ত মনের । বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে প্রাপ্তি মাকে প্রায়েই বলে ,
____ আসলেই আম্মু , এইত আর ৬ মাস । আর বেশি দিন তো নয় । তারপর আমার চিকিৎসা শেষ । আমি সব খেতে পারব । সবখানে বেড়াতে পারব । এই আনন্দে চনমন করে উঠে তার মন । একদিন সে পুরোপুরি সেরে উঠবে । এটা ভাবতে ভাবতে সে ক্লান্তু মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে ঘুমিয়ে পড়ে ।
প্রাপ্তির চিকিৎসা এখন প্রায় শেষের দিকে । সবে ছয় মাস বাকি । প্রাপ্তিকে দেখে যে কেউ বলবে সে একদম সুস্থ হয়ে গেছে । স্বাস্থ্য আর চেহারা দুটোই ফিরে গেছে তার । খুব প্রফুল্ল থাকে আজকাল । গোসলের পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল গামছায় পেঁচিয়ে খোঁপা করতে করতে নিজেকে দেখে আর গুনগুন করে আপনমনে গান গায় । একটা বড় বড় ভাব চলে এসেছে তার মাঝে । এমন দৃশ্য লাভলীর খুব চেনা । মায়ের মতো আজকাল তারও সাজতে ইচ্ছে করে । লাভলী সময় পেলেই তার জন্য নানা নকশা করে জামা বানায় । তার সাথে মিলিয়ে চুড়ি , টিপ আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে দেয় । প্রাপ্তিকে এক পলক দেখেই সবাই বলে উঠে , এমা ! কি সুন্দর স্বাস্থ্য আর চকচকে চেহারা হয়েছে তোমার ! বড় দুটো চোখে কাজল আর সুন্দর নরম দুখানা হাতে চুড়ি পড়ে সেজে বের হলে তার দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না । তার রূপের আবেশ যে কারো নজর কেড়ে নেয় ।
মাঝে মাঝে বিকেল বেলা মা চুল বেঁধে দিলে বারান্দায় দাঁড়ায় প্রাপ্তি । বাতাসে লম্বা ঘন কালো ঝলমলে চুলে দাঁড়িয়ে, সে পথ চলতি মানুষদের দেখে । চেনা কাউকে চোখে পড়লেই সালাম দিয়ে তার কুশল জানতে চায় । পরিচিত জন, পাড়া-প্রতিবেশী আর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে খুব মিশুক মেয়ে প্রাপ্তি। বাড়িতে মেহমান আসলে অন্য সবার মতো তারও ব্যস্ততা বেড়ে যায় । কখন কার কি লাগবে , কার জন্য তার মাকে কি খাবার তৈরি করতে হবে, সব সে বলে দেয় । বাসার অন্য সবার মতো পলাশের উপর তার বিশেষ নজরদারি থাকে । দাদীকে প্রাপ্তির খুব পছন্দ ,অবসর সময় গুলো দাদীকে ঘিরেই তার কেটে যায় । দাদী যেমন সবকিছু পরিপাটি রাখতে পছন্দ করে তারও সবকিছু এমন হওয়া চাই । মেয়েকে এমন ভাল দেখে লাভলী আর পলাশের মনে আশার আলো আবার ও নতুন করে জাগতে শুরু করে ।
মেয়ের চিকিৎসা শেষ হলে তারা কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে , তার একটা পরিকল্পনা ও ঠিক করে রেখেছে পলাশ । প্রাপ্তি খেতে খুব ভালবাসে । তবে বাইরের খাবার নিষেধ বলে, ইউটিউব দেখে দেখে মা মেয়ে মিলে অনেক রান্না করা ইতিমধ্যে শিখে নিয়েছে ।
এদিকে প্রাপ্য ও বড় হয়ে যাচ্ছে । ছেলের স্বভাব একেবারেই মেয়ের উল্টো । সারাদিন হৈচৈ করে বাড়ি মাথায় তুলে । বোনের গোছানো খেলনায় গিয়ে হামলা দেয় । কখনও খেলনা ছুঁড়ে মারে । এমন এলোমেলো আর ভাঙ্গা খেলনা দেখে প্রাপ্তির খুব মন খারাপ হয় ।
প্রাপ্তি পড়াশুনায় ও বেশ ভাল । কেজিতে রোল নাম্বার ৪ হবার কারণে আজ মন তার বেশ খারাপ । তার তো প্রথম হবার কথা । এতো বড় অসুখ নিয়েও সে ঠিকঠাক তার পড়াশুনা চালিয়ে নেয় । পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি আরবি শিক্ষাও সে বেশ ভাল আয়ত্ত করে ফেলেছে । খুব তাড়াতাড়ি দাদীর মতো সে নামাজে দাঁড়াবে । অনেক সূরা তার মুখস্ত করা শেষ । বাসার মতো ক্লাসেও খুব লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে সে । অসুখের পর থেকেই একটা স্বপ্ন তার মনে খুব করে দানা বেঁধে উঠেছে , বেঁচে থাকলে সে ডাক্তার হয়ে ক্যান্সার রুগীদের চিকিৎসা করবে ।
একটা পরিবারেই কেবল জানে তাদের কিসের ভিতর দিয়ে এই কয়েকটা বছর শেষ হয়েছে । এতো টুকুন একটা বাচ্চা কি কিরে এমন কঠিন রোগের সাথে লড়াই করতে পারে ! যে লড়াইটা করে, সেই কেবল জানে । মাঝে মাঝে পৃথিবী প্রাপ্তির পরিবারের কাছে বড় নিরানন্দ আর বিষাদময় হয়ে উঠে । হতাশা গ্রাস করে নেয় তাদের সবটুকু । একটা কথাই কেবল তাদের মনে ঘুরে ফিরে __ আল্লাহ কেন আমাদেরকেই এই কঠিন পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করলেন আর প্রাপ্তিকেই বা কেন ! তবে মেয়ে এখন খুব সুস্থ আছে । এটাই আশার কথা । এইতো আর কটা দিন । তারপর আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে । এটা ভেবেই আবার তারা মনকে শক্ত করে ।
একদিন মাঝেরাতে হঠাৎ লাভলীর ঘুম ভেঙ্গে যায় । সে খেয়াল করল পলাশ বিছানায় নেই । এত রাতে তো কোথাও যাবার কথা নয় । ভয়ে আর সংশয়ে ভেতরটা কেমন যেন দুলে উঠল । গভীর রাত । বাথরুমের ও আলো নিভানো । কয়েক পা এগিয়ে বসার ঘরে যেতেই দেখে , পলাশ তার মুঠো ফোনে ব্যস্ত । লাভলীর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল । এত রাতে কার সাথে কথা বলে পলাশ ! আড়াল থেকে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে, মুখ খানা গম্ভীর করে খুব মন দিয়ে ক্যান্সারের বিষয়ে কিছু একটা পড়ছে । পলাশ ও বুঝতে পারে , লাভলী তার পেছনে দাঁড়ানো । অসহায়ের মত লাভলীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল , কি উঠলে যে, ঘুম আসছে না বুঝি ? বসো তাহলে একটু আমার পাশে ,তোমার সাথে কথা আছে ।
ঘুম জাড়ানো মুখে লাভলী বলল , কি বলবে বলো ।
একটু চুপ করে থাকে পলাশ । তারপর খুব অদ্ভুত গলায় বলে , নিজেকে শক্ত করো । ব্রু কুঁচকে লাভলী উত্তর দিল , কেন বলছ এমন কথা ?
____ বাচ্চাদের ক্যান্সার ভাগ্য খুব ভাল নয় । একদিন হয়ত এমন হবে যে প্রাপ্তি আমাদের সাথে আর থাকবে না । নিজেকে তার জন্য প্রস্তুত করো ।
কথাটা শুনে বেশ ঝাঁজালো গলায় লাভলী বলে উঠল , কি বোলো তুমি ? আর হঠাৎ এমন কথা কেনই বা বলছ ! প্রাপ্তি অনেক বাচ্চা থেকে অনেক ভাল আছে । অন্য সব বাচ্চাদের যেখানে প্রায়েই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় , সেখানে প্রাপ্তি কেবল একবার ভর্তি হয়েছে । তাছাড়া আর মাত্র ছয় মাস । তারপর ও একদম ভাল হয়ে যাবে । তাছাড়া ওর রক্তে ক্যান্সারের কোন জীবাণু নেই । আর তুমি কেন এমন এলোমেলো কথা বলছ , বুঝতে পারছি না । লাভলীর কথা শুনে পলাশ তার ভিতরে একটা অসহায় কান্নার ভাব লুকিয়ে , কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
শেষ থেরাপি পনেরো এপ্রিল, ২০১৮ । এই শেষ ! আর প্রাপ্তিকে কষ্ট করতে হবে না । প্রতি থেরাপির পর মেয়ের দুর্বল আর বিষণ্ণ মুখটা দেখতে তাদের ভাল লাগে না । মেয়েটার সাথে সাথে তারা নিজেরাও অনেক কষ্ট করে । একে তো মেয়ের দুর্বল শরীর , কিছু খেতে চায় না । তবুও জোর করে খাওয়াতে হয় । সাত দিন এমন কষ্টের পর প্রাপ্তি একদম সুস্থ । অসুখ বলে মনেই হয় না । তবে থেরাপির দেবার সাত দিন পর জ্বর এলে খুব খারাপ । তখন সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় । প্রাপ্তির বেলায় এমনটা কখনও হয় নি ।
কিন্তু এক অজানা কারণে এই শেষ থেরাপির ঠিক ছয় দিন পর প্রাপ্তির জ্বর এলো ! তা দেখে মেয়েকে জলদি হাসপাতালে ভর্তি করায় পলাশ । রক্ত পরীক্ষার পর হাসপাতালে কাজ করে, লাভলীর খাইরুল নামক এক বন্ধু সাথে সাথে প্রাপ্তির রিপোর্ট বের করে দেয় । রিপোর্টে ক্যান্সারের কোন জীবাণু নেই তবে ইনফেকশান ধরা পড়েছে ! সময় নষ্ট না করে প্রাপ্তিকে খুব তাড়াতাড়ি গুলশান ২ ল্যাব এইডে ডঃ দেখিয়ে, পি জি তে ভর্তি করানো হল । এভাবে ৫-৬ দিন কাটে । জ্বর আসে আবার চলে ও যায় ।
এরপর হঠাৎ একদিন প্রাপ্তির প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হল তারসাথে পাতলা পায়খানা । প্রাপ্তি কিছুই খেতে পারছে না । মেয়ের অবস্থা দেখে সবাই চিন্তায় পড়ে গেল । এমন তো এর আগে কখনও হয়নি । শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বলে , মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো হল ।
এর ঠিক কয়েকদিন পর প্রাপ্তির শরীর ফুলে যায় । ক্যানোলা করা যাচ্ছে না । অনেক কষ্টে ও তার শিরা খুঁজে পাওয়া গেল না । ডাক্তারকে দেখলেই ক্লান্ত গলায় প্রাপ্তি তাদের শুধু তরমুজ খেতে দিতে বলে । কিন্তু তাকে এই অবস্থায় তরমুজ দেয়া বারণ ।
মে মাসের ৪ তারিখ , শুক্রবার, ২০১৮ । আজ প্রাপ্তিকে দেখতে অনেকটা ভাল লাগছে । গত দুই দিন মুখটা ফ্যাকাসে আর তার মাঝে এক ধরণের অস্থিরতা ছিল । দুই একদিন সে এলোমেলো কথা বলেছে । তেমন কিছু মনে করতে পারেনি । এখন সব কিছু মনে করতে পারছে । সারাদিন এভাবে ভালো কাটলেও রাত এগারটার পর থেকেই তার অবস্থা খুব খারাপ হতে শুরু করল । প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট , অক্সিজেন লেভেল ৬৫, ৬২ , ৬০ , ৫৫ , ৫০ করে নেমে আসছে ! শ্বাসকষ্ট সইতে না পেরে মুখটা বিকৃত করে নিচের ঠোঁটটা বারবার কামড়াচ্ছে । গলার স্বর ও তেমন ফুটছে না । তবুও খুব কষ্ট করে একবার বাবা মাকে তার কাছে ডাকল ।
পলাশ কাছে এসে ঝুঁকে বলল , খুব কষ্ট হচ্ছে, মা ?
অস্পষ্ট গলায় প্রাপ্তি বলল ,
____ একটু কাছে এসো । আমি তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি । যদি আমি মারা যাই তবে একদম কাঁদবে না , কেমন । অনেক কষ্টে কথাটা শেষ করে বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কষ্ট করে তাদের গালে কয়েকটা চুমু খেল । মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খেতে লাভলী বলল , এসব কেন বলছ, মা ? তুমি আমাদের খুব লক্ষ্মী মেয়ে । তুমি কোনদিন আমাদের একদম বিরক্ত করো নি। আমরা তোমাকে অনেক ভালবাসি । মেয়ের এমন কথা শুনে পলাশ মেয়ের হাত ধরে নিথর হয়ে বসে মুখে কান্নার ভাব নিয়ে ,অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে চেয়ে রইল ।
____ আম্মু , নানু কোথায় ? নানুকে ডাক । আমার পাশে একটু বসুক । আমি নানুর মুখে গল্প শুনতে চাই । আর দাদুকে জলদি খরব দাও । তাড়াতাড়ি করো, আম্মু । আর সময় নেই । কথা গুলো বলে প্রাপ্তি চুপ হয়ে ঘুমে ঢলে পড়ল ।
রাত তখন ঘড়ির কাঁটায় ১২ টা ছুঁয়েছে । নানু আসবে বলে দাদী আজেই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে । গত ১১ দিন টানা হাসপাতালে থেকে থেকে লাভলী শারীরিক ভাবে খুব ক্লান্ত হয়ে উঠেছে । তার মাকে দেখে, আজ খুব সাহস হচ্ছে তার । মা জেগে আছে বলে গভীর ক্লান্তিতে প্রাপ্তির পাশে লাভলীর চোখ বুজে আসে । ঘুম ভেঙ্গে প্রাপ্তি মাকে তার পাশে ঘুমোতে দেখে, তার নানুর কাছে এক দু’বার পানি চেয়ে নিল । রাত বেড়ে তখন গভীর । এর মাঝে ডাক্তার এসে প্রাপ্তিকে একবার দেখে গেলেন । তার শ্বাসপ্রশ্বাসটা আজ একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে দেখে ডাক্তার সাহেব পলাশকে আড়ালে ডেকে বলল , কিছুক্ষণ প্রাপ্তিকে আমরা বিশেষ নজরজারিতে রাখতে চাই । প্রাপ্তির মাকে আপনি বাইরে বসার ব্যবস্থা করুন আর আপনি আপনার মেয়ের সাথেই থাকুন ।
লাভলীকে বারান্দায় বসতে বলা হল । ভিতর থেকে প্রাপ্তির গোঙানির আওয়াজ তার কানে আসছে । বারান্দায় বসে বসে সে ভাবছে , এবার আমার মেয়েটা সত্যিই খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে । বেঁচে থাকা কি যে দারুন ব্যাপার , কেউ অসুস্থ না হলে তা বুঝা যায় না । এর ঠিক আধা ঘণ্টা পর শব্দটা আর শুনা যাচ্ছে না । সব ডাক্তারদের গম্ভীর হয়ে রুম থেকে বের হতে দেখে, ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় তার হাত পা । গুমরে মুচড়ে উঠে তার মন । দৌড়ে ভিতরে গিয়ে দেখে, প্রাপ্তির নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে । তার অক্সিজেন মাস্ক খুলা !
লাভলী মানতেই পারছে না পৃথিবীতে তার মেয়ে আর নেই । এদিকে পলাশ প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে মেয়ের লাশ হাসপাতাল থেকে বের করার ব্যবস্থা করছে । সে বুঝতে পারছে গভীর হতাশা আর দুঃখে সে ডুবে যাচ্ছে । তবুও মেয়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরে ও, সে একদম মুচড়ে পড়েনি বরং তার মনে হচ্ছিল এতো মানুষের ভিড় , কিন্তু ঘরে তো তেমন খাবারের ব্যবস্থা নেই । খুব জলদি তাদের খাবারের বন্দোবস্ত করা প্রয়োজন ।
বুকে পাথর চেপে মেয়েকে শেষ বিদায়ের সব আয়োজন করল পলাশ । মৃত্যু তার কাজ শেষ করেছে , মৃত্যু জাহাজ খুব জলদি প্রাপ্তিকে নিয়ে এবার এপার ছাড়বে । তাই মেয়েকে লাল বেনারসির বদলে সাদা কাফনে জড়িয়ে, গায়ে আগরের গন্ধ মেখে, তাদের ভালবাসার সন্তানকে চোখের জলে শেষ বিদায় দিল পলাশ । নিথর শরীরে নাক দিয়ে বেয়ে পরা শেষ রক্তবিন্দু আর নিচের ঠোঁটে অনেক গুলো কামড়ের কালো দাগ ছিল ,পলাশের চোখে রেখে যাওয়া প্রাপ্তির মৃত্যুর শেষ চিহ্ন । এতদিন শুনে আসা বাক্যটা আজ সে অনুভব করল, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু হল, বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ !
কত স্বপ্ন ,কত অনুভূতি ,বাঁচার আকুতি , চাপা কান্না সব কিছুকে আজ কবর দিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল পলাশ । সে টের পাচ্ছিল তার বুকের ভিতর কান্নার স্রোত সব ভেঙ্গে চূড়ে ফণা তুলে চোখের দিকে এগিয়ে আসছে । তবে প্রাপ্তির মারা যাবার পর দুই তিন দিন পৃথিবীতে ঠিক কি কি ঘটেছে, লাভলীর তা জানা নেই ।
দু বছর হয়ে গেল প্রাপ্তি নেই । প্রাপ্তিহীন পৃথিবীতে দুঃখে মোড়ানো অপ্রাপ্তি-তে পলাশ আর লাভলীর বিষণ্ণ হয়ে নিঃশেষ হয় প্রতিটি দিন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ের কথা মনে পড়তেই , চোখে জল ছুটে এসে তার ভারী কাজলে আটকা পড়ে । এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কতবার সে প্রাপ্তিকে সাজিয়েছে । প্রাপ্তির ঝলমলে চুলে আজও তার বিলি কাটতে ,তার কপালে চুমু খেতে ইচ্ছে করে । ইচ্ছে করে হাতে গুলো ধরে বসে থাকতে । মেয়েটা তার চোখের সামনে অন্তত বেঁচে থাকতে পারত । প্রাপ্তি বেঁচে থাকলে কত সুখের হতে পারত, তাদের জীবনের বাকি সব কটা দিন ।
প্রপ্তির মারা যাবার পর থেকে আর কোন দিন তার প্রিয় খাবার গুলো বাসায় রান্না করা হয় না । বাজারে তরমুজ দেখলে পলাশ চোখ ফিরিয়ে নেয় । এখন আর বাজারের ব্যাগ ভরে মেয়ের জন্য করল্লা আনে না পলাশ । লাভলীর সাথে বাইরে বের হলেই প্রাপ্তি চিপস খেতে চাইত । কিন্তু কেনা খাবার তার বারণ বলে চিপসের প্যাকেট ধরে শুন্যমুখে চিপসের স্বাদ নিত আর মায়ের দিকে করুণ চোখে চেয়ে থাকত আর বলত , ভালো হলে আমি সব খাব , আম্মু । দোকানে ঝুলানো চিপস দেখলেই, লাভলীর ভেতর কষ্টেরা আজও দুলে উঠে ।
পলাশ মাঝে মাঝে শখ করে পান চিবায় । মেয়ের এটা মোটেও পছন্দ ছিল না । আজকাল আর সে নিজের দিকে তাকায় না । রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায় অনেক খাবারে , তবুও সে অনায়াসে মিষ্টি খায় । বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে পড়ন্ত আলোর নিস্তেজ বিকেল তার চোখে বিষণ্ণ হয়ে শেষ হয় । নিয়তিকে মেনে নেয়া ছাড়া তার যে কিছু করার নেই ।
আজও গভীর রাতে বৃষ্টি হলে প্রায়েই লাভলীর ঘুম ভাঙ্গে। চোখ বন্ধ করতেই সে চলে যায় দূর গ্রামের সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার জায়গাটায় যেখানে কোন জনমানব নেই । চারপাশে ঝি ঝি পোকার পাহারায় শুয়ে আছে তাদের আদরের সন্তান । বৃষ্টি হলে যেখানে ভিজে যায় তার মেয়ের কবরের ঘাস । চোখ খুলতেই যন্ত্রণায় ককিয়ে কেঁদে উঠে তার মন । কষ্টটা হালকা করার জন্য কখনও ডায়েরি নিয়ে লিখতে বসে , কখনও খাতার পাতায় ভরে উঠে, পেন্সিলের আঁচড়ের নানা নকশা যা প্রাপ্তির খুব পছন্দের ছিল । লিখতে বসলে বুকে প্রচণ্ড ব্যথার হয় বলে , অনেক কিছু তার লিখা হয়ে উঠে না ।
প্রাপ্তির নামের সাথে মিল রেখে তাদের ছেলের নাম রাখা হয়েছে প্রাপ্য । প্রাপ্তি মারা যাবার সময় তার বয়স ছিল দুই বছর চার মাস । কিছুটা সময় বোনকে সে পেয়েছিল । আজও সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এ ঘর থেকে ও ঘর তার আপিকে খুঁজে বেড়ায় । এখন আর কেউ তাকে খেলনা ধরতে বাঁধা দেয় না । সব খেলনা তার একার । কিন্তু তার আপি কোথায় এটা তাকে মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তুলে । খেলনা , জামা কাপড় , বই-খাতা রেখে হঠাৎ আপি কোথায় যেন চলে গেল । মাঝে মাঝে সে খুব আগ্রহ নিয়ে বাবা মায়ের কাছে তার বোনের কথা জানতে চায় । সে জানে তার আপির অনেক বড় অসুখ হয়েছে । চিকিৎসা শেষ হলেই ,আবার সে বাড়ি ফিরবে ।
নিজেকে এখন অনেকটাই শক্ত করেছে লাভলী । স্বামী , সংসারের জন্য হলেও তার ভাল থাকতে হবে । পলাশ লাভলী এখন দুজন দুজনকে সান্ত্বনা দেয় । তবুও মাঝে মাঝে মাতৃত্ব হাজার বাঁধা আর সান্ত্বনা ভেঙ্গে জেগে উঠে । তখন সে আলমারিতে যত্নে তুলে রাখা প্রাপ্তির জামা কাপড় বের করে দেখে । কাপড়ে যেন আজও তার মেয়ের গায়ের গন্ধ লেগে আছে । বই খাতা বের করে ধীর আঙ্গুলে পাতা উল্টায় , খুব অস্থির লাগে তখন । আবার নিজেকে এটা ভেবে সান্ত্বনা দেয় যে কান্সারের বাচ্চারা ধীরে ধীরে অনেকেই একসময় হারিয়ে যায় । মেয়েটা বেঁচে থাকলে হয়ত আরও কষ্ট পেত । আল্লাহ্ যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন । নামাজ ছাড়া এখন আর তার তেমন কিছু ভাল লাগে না । জায়নামাজে বসে সে প্রায়েই একটা কথাই বলে , __ আপনার কাছে তো অনেক এমন প্রাপ্তি আছে ! আমাকে আর একটা প্রাপ্তি দিন । আপনি তো দয়ার সাগর ! এই মায়ের কথা কি আপনি শুনবেন না ? আমি যে আমার মেয়েকে ভুলতে পারি না !
একসময় মে মাস ছিল খুব আনন্দের । পলাশ আর প্রাপ্তির জন্মদিনের জন্য লাভলীকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হত । এখন এই মাস এলেই মনের ভিতর দুঃখেরা ঘনিয়ে আসে । ঔষধ ছাড়া এখন ঘুম আসে না ।
বাইরে মেয়ের বয়সী কাউকে দেখলে অসহায়ের মতো স্থির চোখে, তাদের চোখ আটকে যায় । কত আনন্দময় হবার কথা ছিল দিনগুলো । এই দুই বছরে মেয়েটা কত বড় হতো ! মাঝে মাঝে প্রাপ্তিকে তাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করে । তার প্রিয় পিঠা বানালেই স্বপ্নে এসে মায়ের সাথে দেখা করে যায় প্রাপ্তি । অনেক কথা হয় মা আর মেয়ের । মেয়েকে স্বপ্নে দেখে কয়েকমাস লাভলীর খুব ভাল কাটে । প্রাপ্যর জন্মদিনে প্রাপ্তির জন্য আজও লাভলী কেকের একটা অংশ আলাদা করে রাখে ,সবার চোখের আড়ালে ।
এই যে মানুষের এতো দুঃখ ,কষ্ট তবুও জীবন প্রতি মুহূর্তে আমাদের তীব্রভাবে বাঁচার তাগিদ দেয় । এমন আদরের সন্তান হারানোর ব্যথা বুকে নিয়েও, লাভলী মাঝে মাঝে পলাশের জন্য চমৎকার শাড়ি পরে । আয়নার সামনে দাঁড়ালেই মেয়েটাকে চোখে ভাসে । বুকের ভারীভাব দীর্ঘ শ্বাস হয়ে বের হয়ে যায় । চোখে ভারী কাজল দেবার সময় পলাশ এসে পাশে দাঁড়ায় । গোল ভরাট চেহারার মিষ্টি মুখশ্রীর এই মেয়েটাকে কাতান শাড়িতে তার দারুন লাগে । আয়নায় পলাশের কোমল দৃষ্টি ঘরের বাতাসে পরস্পরের গভীর ভালবাসা জানান দেয় । শাড়ির আঁচল ডান দিক দিয়ে ঘুরিয়ে আনতে আনতে লাভলীর আজকাল কেবলই মনে হয় , তার কাতান শাড়ির রঙ্গিন সুতোর পাড়ের নিচে, যে একটা স্থায়ী আর গভীর দুঃখ লুকিয়ে আছে তা পৃথিবীর কেউ জানে না । পলাশের মতো স্বামীকে পেয়ে তার জীবন ধন্য হয়েছে । কিন্তু কে জানত প্রচণ্ড সুখ আর প্রচণ্ড কষ্ট একসাথে তাদের ঘরে থাকবে বলে , গোপনে একদিন চুক্তি করেছিল ।
লেখকঃ আলিফ আলম
মন্ট্রিয়ল, কানাডা।