মানুষ- সমাজ

মোঃ নাজিম উদ্দিন, বীর প্রতীক

নরসুন্দা ডটকম   ডিসেম্বর ১৯, ২০১৬

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার উসমানপুর ইউনিয়নের চৌহদ্দী গ্রামে মো. নাজিম উদ্দিনের জন্ম। বাঙালিরা যে পাকিস্তানিদের বৈষম্যের শিকার ছোটবেলা থেকেই এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি। একাত্তরে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে হাবিলদার পদে চাকরি করতেন এই প্রতিবাদী তরুণ । যুদ্ধ শুরু হলে রণাঙ্গণে সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন তিনি। পরে তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরে এ বাহিনীর বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে যুদ্ধে যাবার আলোচনা ও প্রস্তুতি চলছিল। মার্চের শেষ দিকে হাবিলদার নাজিম উদ্দিনসহ অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের কিছু সৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। তখন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ডিফেন্সে ছিল। মেজর আমিনুল হক তখন নেতৃত্ব ছিলেন। তখন তাঁর সাথে আসা ২০-২৫ জন বাঙালি সৈনিকসহ চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের নেতৃত্ব নেন মেজর শাফায়াত জামিল।

এ অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় বিমান আক্রমণ করলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা বিভক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নাজিম উদ্দিন বীর প্রতীক তাঁর নিজ বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে চলে আসেন। পরে স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণসহ যুদ্ধের কলাকৌশল শেখান। ১৫-১৬ এপ্রিলের দিকে তিনি ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে পৌঁছে দেন। আবার ফিরে আসেন কুলিয়ারচরে। দ্বিতীয়বার আরো ৪০ জনকে নিয়ে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে তেলিয়াপাড়ায় চলে যান। পরে তিনিসহ প্রাক্তন সৈনিকদের একটি দল মহিষখলাতে (বিওপি) অবস্থান করেন। কিছুদিন থাকার পর ঐক্যবদ্ধভাবে হাবিলদার নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ১৪ জনের মুক্তিযোদ্ধা দলটি গভীর বৃষ্টিভেজা রাতে লুঙ্গি পরে রামদা ও লাঠি নিয়ে মে মাসে ধরমপাশা থানা আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে পাঞ্জাবি ওসিসহ অন্যরা পালিয়ে যায়। এ সময় এই ছোট দলটি থানা থেকে ১৫টি রাইফেল ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নিয়ে আসেন।

এ ঘটনার পর তারা আবারও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলে ফিরে যান। তখন মেজর জিয়াউর রহমান সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ভারতের তেলাদালা কুচবিহারে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সাথে তারা যোগদান করেন। নাজিম উদ্দিন সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। পরে ১২০ জনকে নিয়ে ইয়ুথ কোম্পানি গঠন করা হয়। ইয়ুথ কোম্পানির দলনেতা নির্বাচিত হন তিনি। ১২০ জনের দলটিকে নিয়ে আগরতলার করিমগঞ্জ দিয়ে দেশে প্রবেশ করে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় যান। গোপালগঞ্জের কমলপুরে পাকিস্তানি বাহিনী শক্তিশালী ডিফেন্স নেন। এ খবর পেয়ে নাজিম উদ্দিনের দলটি সংঘবদ্ধ হয়ে পাক হানাদার বাহিনীর ডিফেন্সে সাঁড়াশি আক্রমণ চালান নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। এ সাহসী আক্রমণে পাক হানাদার বাহিনীর ডিফেন্স ভেঙে যায়। মুক্তিযোদ্ধা দলটি পাক হানাদার বাহিনীর হাবিলদার সাদেক আলী ও সিপাহি রফিককে জীবন্ত আটক করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ৮-১০ জন পাক সেনা নিহত হয়। এ যুদ্ধের পর নাজিম উদ্দিনের দলটি সেখানেই স্থায়ী ক্যাম্প গঠন করে অবস্থান গ্রহন করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তিনি ও তার দলটি সেখানেই ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট একত্রিত হয়ে চট্টগ্রাম ইউনিটে চলে যায়। নাজিম উদ্দিন নায়েব সুবেদার হয়ে চাকরি করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এই বিশাল অবদানের জন্য স্বাধীনতার পর নাজিম উদ্দিনকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। অনারারি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হয়ে ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

বর্তমানে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার উসমানপুর ইউনিয়নের চৌহদ্দী গ্রামে নিজ বাড়িতে আছেন।

নাজিম উদ্দিনের বাবা আরব আলী ও মা মিশ্রি বেগম মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রী খালেদা বেগম। তিনি দুই মেয়েসন্তানের জনক। মোঃ নাজিম উদ্দিন অবসর ভাতাসহ কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে থাকেন।

মোঃ নাজিম উদ্দিন স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর, রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান। তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরই এদের বিচার হওয়া উচিত ছিল। তবে এখন যে বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তাতেও দেশের মানুষ স্বস্তি পাচ্ছেন। তিনি দুঃখ করে বলেন, ৪০ বছরে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। এদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

 

0022

লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment