ঈদ সংখ্যা ২০২০

ত্রাণ ও জনসেবা বিষয়ক একটি নিরীহ গল্প ।। মুহাম্মদ শামীম রেজা

নরসুন্দা ডটকম   মে ২১, ২০২০
জনসেবা

খুউব কম জনপ্রতিনিধি-ই মহামারি কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময়টা অপছন্দ করেন। বরং এই সময় তাঁদের অন্তরাত্মা আন্দোলিত হয়। তাঁরা প্রফুল্লচিত্তে এই সময়গুলোকে উপভোগ করেন। বিষয়টি সহজেই অনুমেয়।

আসুন ব্যাপারটা পরিস্কার করা যাক। পি আই অফিস থেকে ফোন এসেছিল। মহতি ইউনিয়ন পরিষদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রায় বিশ লাখ টাকা মূল্যমানের ত্রাণ এসেছে। বয়সে তরুণ মাহবুব আলম, চেয়ারম্যান মহতি ইউনিয়ন পরিষদ, তিনি বেজায় খুশি। ভাবছেন – এমন মহামারী চলতে থাকুক না! আর এভাবেই ত্রাণ আসুক। মোবাইল বাজতে থাকে, মাহবুব চেয়ারম্যান পকেট থেকে ফোন বের করেন।- মেম্বার রাইতে দেখা কইরো জরুরি আলাপ আছে। চেয়ারম্যান পকেটে ফোন রেখে হাঁক ছাড়ে – কুসুম গেলাম। ফিরতে রাইত হইবো। দুপুরে খামুনা। হনহন করে বেড়িয়ে যায় মাহবুব চেয়ারম্যান।

স্ত্রী কুসুম তাতে অবাক হয়না। গত তিন তিনটি বছরে চেয়ারম্যানের এমন আচরণ দেখে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। – কিছু একটা ভুলে গেছেন মনে হয়… – ঢং কইরো না তো। তোমার ঢংয়ের থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাইতাছি… বিরবির করে আরো কি যেন বলতে বলতেই অদৃশ্য হয়ে যায় মাহবুব চেয়ারম্যান। যা স্ত্রীর কান পর্যন্ত পৌঁছে না। স্বামীর খিস্তিখেউড় যদি তার কান পর্যন্ত পৌঁছাতো। হয়তো সে অবচেতন মনেই বলতো – হায়! অভাব নয় অর্থ যখন দরজায় এসে দাঁড়ায় ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়!

একটু পেছন ফেরা যাক। শহুরে মেয়ে কুসুম। একই কলেজে পড়তে গিয়ে ভালো লাগার সূচনা। তারপর জানাশুনা। এবং তারপর পারিবারিক ভাবে বিয়ে অবধি পর্যন্ত পৌঁছা। কিন্তু এই জার্নিটা এতো সহজ ছিলো না। বিশেষত বাবা কখনো-ই গ্রামের অতি সাধারণ একটা পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দিতে চাননি। বাবা বলতেন ব্যাপক বিত্তবৈভবের মধ্যে বড় হওয়া কুসুম কখনোই ওই অতি সাধারণ পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে না। তার এক কথা- আবেগ সাময়িক ব্যাপার, যা দিয়ে জীবন চলতে পারে না। অবশ্য মেয়ের জেদের কাছে পরাস্ত হন বাবা। অনানুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে দেন মেয়েকে। পাছে ধনাঢ্য আত্মীয় স্বজনদের কাছে ছোট হতে হয় এই ভয়ে! তাতেও অবশ্য আপত্তি করেনি কুসুম। কারণ তার পরম আরাধ্য মানুষ মাহবুবকে জীবনের অংশ হিসেবে সারাজীবনের জন্য পাচ্ছে তাইবা কম কিসে!

কুসুম ঠিকই মানিয়ে নিয়েছিল। বিয়ের পর থেকেই তাদের মধ্যে অলিখিত এক নিয়ম চালু হয়েছিলো দুজনের। মাহবুব চেয়ারম্যান কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেই কুসুম বলতো – কিছু ভুলে গ্যাছো মনে হয়… মাহবুব বলতো -ভুলি নাই, ভুলি নাই। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে স্ত্রীর কপোলে চুমু এঁকে দিতো। কুসুম তখন লজ্জায় মরে যাচ্ছে এমন ভাব করে বলতো – সর্বনাশ কি করছো তুমি। পাগল হলে নাকি! কেউ দেখে ফেলবে তো..! মুখে সর্বনাশ বললেও মনে মনে ঠিক উল্টো চাইতো। যেন অনন্তকাল এভাবেই ধরে থাকে তার মানুষটা, একান্তই নিজের মানুষটা। মাহবুব যখন আদুরে ভঙ্গিতে জড়িয়ে থাকে কি যে ভালো লাগে..! কিন্তু আফসোস সময়ের সাথে সাথে উল্টো স্রোতে চলতে লাগলো মাহবুব। কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।

রাজনৈতিক ব্যাপারটাকে এখন সতীনের মতো লাগে কুসুমের কাছে। রাজনীতি বিষয়টা এখন ক্ষমতা লিপ্সা আর অর্থ লিপ্সা ছাড়া কিছুই না। কয় জনে জনসেবার জন্য রাজনীতি করে? বড়জোড় লাখে একজন? তাতেও সন্দেহ আছে বৈকি! এই যে মাহবুব ইদানিং এতটা ছোটাছুটি করছে তা কি জনসেবার পর্যায়ে পড়ে? বরং সরকারের দেওয়া জনগণের ত্রাণ মেরে খাওয়ার ধান্দায় দৌঁড়াচ্ছে। এই করোনাকালে কত মানুষ না খেয়ে উপবাস করে দিন কাটাচ্ছে! আর মাহবুবরা এই উপবাসী মানুষের অন্ন কেড়ে নিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করছে। আফসোস সমাজে মাহবুবদের সংখ্যা-ই বেশি। আবার নিঃস্বার্থভাবে নিরন্ন মানুষেরদিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া লোকজনও নেহায়েত কম নয়। তবে তারা ততোধিক অর্থশালী না।

মাহবুব চেয়ারম্যান এবং তাঁর অনুগত কুদ্দুছ মেম্বার মুখোমুখি বসে আছে। মাহবুব চেয়ারম্যানের বৈঠক ঘর তখন একেবারে সুনশান-নিস্তব্ধ। চেয়ারম্যান এমন নৈঃশব্দ্যময় পরিবেশ-ই চাচ্ছিলেন। কারণ বিষয় অতি গোপনীয়। পাঁচকান হলেই সাড়ে সর্বনাশ!

কুদ্দুছ মেম্বার কথা প্রসঙ্গে বলে – বুঝলেন চেয়ারম্যান সাব কাকদের জাত প্রীতি আছে। বাঙ্গালির তা নাই। কেউ একটা কাক মাইরা ফেললে মূহুর্তের মধ্যে দল বেঁধে প্রতিবাদ করতে আসে। তখন গগন বিদারী কা কা করতেই থাকে। অথচ বাঙ্গালির মাথায় বারি দিয়া মাথা ফাটায় দেন। কেউ ফিরাইতেও আসবো না। দুনিয়ায় আর কোনো জাতি আছে কিনা জানি না, যারা নিজেগো খাইদ্যে বিষ মিশায়! কিন্তু হালার বাঙালি মিশায়। হেরা সব্জিতে ফরমালিন দেয়, ফলে দেয়, মাছে ফরমালিন দেয়। হেন জিনিস নাই যেইডাতে বিষ মিশায় না!

– কুদ্দুছ ভাই তোমারে ডাকছি ত্রাণ বিষয়ে কথা কমু। তুমি দেহি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ জুইড়া দিছো…! বঙ্গবন্ধুর যুগ আছে মিয়া? এক ভাষণে দেশ স্বাধীন! অই সময় মানুষে-মানুষে টান আছিলো। দেশের লাইগ্যা মানুষের দিলে মায়া আছিলো। এহনকার মানুষ গুলো বদের আড্ডি। টাকা ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। ভোটের সময় আসলেই এরা টাকা ছাড়া ভোট কেন্দ্রে যায় না। চল্লিশ লাখ টাকা খরচ কইরা চেয়ারম্যান অইছি। পাঁচশো টাকার বিনিময়ে ভোট বেইচ্চা এরা ত্রাণের আশা করে কেমনে? এরার লাইগ্যা আমার বিশ লাখ ধার-দেনা অইছে। চিন্তা করা যায়!

– তাও তো ঠিক। তা চেয়ারম্যান সাব কতো টাকার ত্রাণ আইছে?

কুদ্দুছ মিয়ার এই প্রশ্নে মনে হয় চেয়ারম্যানের বিরক্তি কেটে যায়। সাতদিন অভুক্ত কুকুরের খাবার পাওয়া চোখের মতো চক চক করে তাঁর চোখ। শ্রমহীন টাকা প্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হলে মানুষের চোখ মনে হয় এমনই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

– তা ধরো বিশ লাখের কাছাকাছি হবে।

-এক কাম করেন চেয়ারম্যান। পি আই অফিসাররে জন্য পঞ্চাশ হাজার, থানার ওসি সাবরে পঞ্চাশ হাজার আর মেম্বারগো জন্য দুই লাখ আর কিছু টাকা সাংবাদিকগো লাইগ্যা। নাইলে এরা দিবে প্যাছ লাইগাই। আর ইস্পিশাল ভাবে আমারে যা দেন… শেষ কথাটা বলার পর কুদ্দুছ মিয়া দুলতে থাকে।যেন সে কোনো প্রভুভক্ত কুকুর। যার প্রধান কাজ-ই হলো প্রভুকে খুশি রাখা।

– তা না হয় বুঝলাম। সাংবাদিকরা টাকা খাইবোনি?

– কন কি চেয়ারম্যান সাব। খাইবো মাইনে। মিনারেল ওয়াটারের মতো খাইবো… এরা রীতিমতো বাডি লইয়া ঘুরে। খোঁজ নিয়া দেহেন এরার আয় কত? কয় টেহা সম্মানি পায়? বেশি না। এরা শুধু লেবাসধারী। এরারে টেহা দিলে লাভের লাভ অইব পত্রিকায় ছবি ছাইড়া দিয়া লিখবো ‘মহতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দরিদ্র মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ’। ছবি তুলতে হবে হাসি হাসি মুখে। কেউ সহজে সন্দেহ করবো না। আর কয় টেহা বিতরণ করেন হেইডা তো আমি আর আপনেই শুধু জানি!

মাহবুব চেয়ারম্যান মনে হয় এই কথার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। গলা খাকরি দিতেই চতুর কুদ্দুছ মেম্বার প্রসঙ্গ পাল্টায় তারপর আরো কিছুক্ষণ কুদ্দুস মেম্বার আর চেয়ারম্যানের মধ্যে নিচু স্বরে ফিসফাস কথা চলে। রাতের গভীরতা বাড়ে। মহতি ইউনিয়ন পরিষদের আমজনতা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তখন রাত জাগাপাখি আর বিশ্বভ্রমান্ডের সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানতেও পারেনা কি নিখুঁত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের ত্রাণ ছিনতাই হয়ে যায়…


মুহাম্মদ শামীম রেজা : গল্পকার।

আরও পড়তে পারেন….
কাক ।। অনিন্দ্য আসিফ
আমাদের গ্রামে যদি রাক্ষস না থাকত ।। সৌরভ চক্রবর্তী
স্বপ্নের জানাজা ।। দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

About the author

নরসুন্দা ডটকম