এই চন্দনা কোথায় আছো? এদিকে তাড়াতাড়ি আরো দুকাপ চা দিয়ে যাও।
ভিতর থেকে আওয়াজ এল, ‘আমি তো একটু আগেই দু’কাপ চা দিয়ে এলাম।
‘–তুমি দেখলে না সুমনা এলো। সুমনাকে মনে আছে? ঐ যে যার মা বিধবা হবার পরে তার স্বামীর একটা জামা নিয়ে বাজারে ঘুরে বেড়াত। কারোর সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করত, ‘আমার স্বামীকে দেখেছ?’
–সুমনা তুমি কি এখন কাজের থেকে এলে? তাহলে তো কিছু খাওয়া হয় নি। দাঁড়াও, আমি তোমার বৌদিকে বলছি।
‘কই গো সুমনার জন্য গোটা কয়েক গরম বেগুনি বানিয়ে দাও মুড়ি খাক, বেচারার চোখ মুখটা শুকিয়ে গেছে।’
কিছু সময়ের মধ্যেই ঘরের ভিতর থেকে আবার আওয়াজ এল, ‘বেসন ফুরিয়ে গেছে, সামনের সপ্তাহে একদিন খাওয়াবো।’
–ওকে সুমনা আই অ্যাম সো সরি। তোমাকে খাওয়াতে পারলাম না। সব কথা নিজের কানেই তো শুনলে। চা আসছে, একটু অপেক্ষা কর। আসলে একটু আগেই এক রাউন্ড হয়ে গেছে। এই যে সুতপা, আর জেসমিনকে দিল। সুতপা…..,তোমাদের আর এক রাউন্ড হবে নাকি, চন্দনাকে বলব?
ভিতর থেকে আবার উত্তর এল, ‘আর চিনি নেই। আবার আগামীকাল।’
আচ্ছা জেসমিন তোমাকে একটু আগে যে কথাগুলো বলছিলাম।আমাদের পঞ্চানন ঠাকুরের কথা জানো? শিবেরই একটা রূপ, হুগলি, হাওড়া, এই সব জেলায় পুজো হয়। ঠাকুরের পাঁচটা মুখ। এদের প্রতিটাই এক একটা প্রতীক। কেউ ধ্যানের, কেউ দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের, কেউ বা রাগের, আসলে এটাই তো আমি। লিখতে গেলে তোমাকে শুধু ধ্যান করতে হবে, আর কিছু নয়। কেন বলতো, লেখা কিন্তু একটা সাধনা। আর এই সাধনার জন্য তোমাকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হবে, আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু বান্ধব। এই আমাকে দেখ, কোথাও যাই না। লিখি, কিন্তু কেউ পড়ে দেয় না।অনেক বড় বড় লেখকের বউরা পড়ে দেয়। একটা ‘র’ এর নিচে যদি পুটকি না পড়লেও ওনাদের চোখে ধরা পড়ে।এটাও এক রকমের সাধনা।গত কাল ‘পূর্বের সকাল’ পত্রিকা থেকে একটা প্রবন্ধ চাইতে এসেছিল। দেবো না, মুখের ওপর পরিষ্কার বলে দিয়েছি। আরে তুমি লেখকেদের অর্থ সম্মান দাও বলে লাট সাহেব নাকি, আমি কাউকে পাত্তা দিই না। তোমরা একটু বসলেই আবার ‘সবুজ বাসর’ পত্রিকার সম্পাদকের সাথে আলাপ করিয়ে দেব।ও ব্যাটাও অনেক দিন ধরে গল্প চাইছে, দেবো না।গল্প কি বিক্রির জিনিস? ভালোবাসার জিনিস। তুমি আমাকে ভালোবাসলে গল্প পাবে, না হলে না। সোজা হিসাব। এই যে চন্দনা এসো এসো, কিছু বলবে।
–এই কাপ ডিস গুলো নিয়ে যাবো?
-নিয়ে যাও। সুমনা একটু বৌদির হাতে হাতে এগিয়ে দাও।যাও চন্দনা, যাও।
চন্দনা নামের মেয়েটি এরপর শূন্য ঘরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রতিটা কাপের থেকে জল নিয়ে আলাদা একটা জায়গায় ঢেলে রেখে ফাঁকা কাপ ডিশগুলো নিয়ে ভিতরের ঘরে যাবার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখল এতক্ষণ ধরে কথা বলে যাওয়া লোকটা একটা চেয়ারের ওপর দুটো পা গুটিয়ে বসে আছে আর নিজের মনেই বলে যাচ্ছে, ‘আমার কাছে গল্প নেবে, অতই সোজা কিচ্ছু দেবো না, কেন দেবো, কেন কেন?’ ওর নাম সুপ্রতীক।
চন্দনা ঘরের বাইরে বেরোতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো।গত পরশুই একটা কাপ ডিশ ছুঁড়ে ভেঙে দিয়ে মুখের ওপর বলেছে, ‘এত দেরি কেন এনারা অতিথি, তোমার অপেক্ষায় বসে থাকবে, একটা ভদ্রতা নেই।’
চন্দনা কিছু না বলে ভাঙা টুকরোগুলো একটা একটা করে তুলছিল, তখনই সুপ্রতীক পিছনে দাঁড়িয়ে বলে গেল, ‘ভুল হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি, আসলে দেরি করলে তো তাই..’
চন্দনা তারপরেই সুপ্রতীককে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে এল।সেকথাগুলো মনে আসতেই চন্দনা চুপ করেই কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকল।তারপর হাতের কাপ ডিশগুলো একটা জায়গায় রেখে সুপ্রতীকের কাছে গিয়ে মাথাতে হাত বুলিয়ে বলে উঠল, ‘কষ্ট হচ্ছে?ওষুধটা এনে দেবো?’
সুপ্রতীক তখনো চেয়ারের ওপরেই দু’টো পা গুটিয়ে অনবরত জোরে জোরে মাথা নেড়ে যেতে লাগল। চন্দনা কিছু সময় ধরে কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘জানলা খুলে দেবো?’
-জানলা! না না খুলতে হবে না। আজ সেই সাহিত্য সভাটা আছে, সেই যে কলেজ মাঠে, আমি যাবো না বললাম। এক্ষুণি জোর করবে। জানলাটা লাগিয়ে দাও, কেউ দেখে ফেললেই মুশকিল। জোর করে নিয়ে যাবে।
চন্দনা আর কোন কথা না বলে জানলা লাগিয়ে ভিতরের ঘরে এগিয়ে যেতেই পিছনের দিক থেকে শুনল, সুপ্রতীক তখনই চেয়ারে উঠে চিৎকার করতে আরম্ভ করে দিয়েছে, ‘এই যে আপনারা আজ আমাকে আপনাদের মাঝে আমন্ত্রণ করে এনেছেন এতে আমি কৃতজ্ঞ……।’
দুই.
রাত তখন কটা হবে, চন্দনা ঘড়ি দেখেনি। ঘুমটা ভাঙতেই বুঝতে পারল বিছানায় পাশে সুপ্রতীক শুয়ে নেই।এমন আগে অনেকবারেই হয়েছে। আগেও মাঝ রাত অবধি লিখত, বিশেষ করে শনিবার বা ছুটির আগের দিন। চন্দনার ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় শুয়ে শুয়েই লেখার ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিত, আলো জ্বললে কোন চিন্তা নেই। কোনদিন আবার লেখার ঘরে গিয়ে কথা বলে আসে। বেশিরভাগ দিনেই তারপর এসে শুয়ে পড়লেও কোনদিন আবার বলে, ‘একটু দেরি হবে, তুমি যাও, আমি আসছি।’
বাথরুম গেল? কিন্তু লোকটা তো কোনদিন রাতে বাথরুম ওঠে না। বাপ্পা বাইরে চলে যাওয়ার পরে একটু ভয়ে ভয়ে থাকে।বিশেষ করে পাশের ফ্ল্যাটের গৌতমবাবু মাস খানেক আগে মারা যাওয়ার পরে ভয়টা আরেকটু যেন বেড়েছে। কয়েকদিন আগেই রাতে শোওয়ার আগে চন্দনাকে বলে, ‘আচ্ছা ধর আমার যদি রাতে কোনদিন ঐরকম শরীর খারাপ হয়, কি করবে তুমি?’ চন্দনা সেদিন কোন উত্তর না দিলেও আজকে লেখার ঘরে আলো না জ্বলতে দেখে একটু ভয়ই পেল। বিছানা ছেড়ে নিচে নামতেই দেখল ব্যালকোনির দরজাটা খোলা। একপা একপা করে তার দিকে এগিয়ে, ‘কি গো কি হল?’ জিজ্ঞেস করতেই সুপ্রতীক কিছু সময় চুপ থেকে বলে, ‘আচ্ছা আমি যে গল্পগুলো লিখি আমি কি তাদের চরিত্রগুলোর বাবা মা?’
–হঠাৎ একথা বলছ কেন?
একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে সুপ্রতীক। ‘আজ অদিতির মা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে, আমি কেন অদিতিকে ওরকম ভাবে মেরে ফেললাম?’
-অদিতি কে?
-আরে তোমার সাথে সেদিন আলাপ করালাম না।
–আমার সাথে আবার কখন আলাপ করালে?
–এই তো সেদিন, একটা গল্প পড়ালাম না,‘তুলাযন্ত্র।’
-তাই বল, একটা গল্পের একটা চরিত্র। এগুলো সব তোমার খ্যাপামি। সব কাল্পনিক চরিত্র, তারা কিভাবে তোমার কাছে আসতে পারে?
-কিভাবে পারে তা তো জানি না, তবে আসছে। আমার কাছে প্রশ্ন করছে। সবকিছু একসাথে ভাবতে পারছি না।
–আমি কালকেই বাপ্পাকে ফোন করছি, এইরকম আজে বাজে কথাবার্তার কোন মূল্য নেই। তাও যদি নামি দামি কোন লেখক হতে, আজ পর্যন্ত তো কোন ভাল পত্রিকাতে কোন লেখা তো প্রকাশ হতে দেখলাম না। প্রকাশ তো হয় ঐ তোমাদের ভাটের লিটিল না কি সব ম্যাগাজিনে। সম্পাদকরা আসেন চা বিস্কুট খান, টাকা পয়সা নেন, তারপর ইচ্ছে হলে লেখা প্রকাশ করেন, না হলে ফুস আর ফাস।’
-যেগুলো বোঝো না সেগুলো নিয়ে কথা বলবে না। এটা অতটা সহজ নয়। যারা টাকা পয়সা খরচ করে তাদের হয়তো হুট হাট বই প্রকাশ হয়ে যায়, বা কোন পত্রিকাতে লেখা প্রকাশ করানো যায়, কিন্তু মানুষের মনে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করা খুব কঠিন ব্যাপার।
–এবং তোমার দ্বারা তা কোনদিনও সম্ভব নয়, বিয়ের আগে থেকে তো বলেই যাচ্ছ, ‘আমি এই লেখক, আমি ঐ লেখক’ কিন্তু গুষ্টির মাথা লিখছ কি প্রকাশই বা কি হচ্ছে?’
-হবে হবে, এই সব ধৈর্য রাখতে হয়, খুব সাধনার বিষয়।
-বয়স কত হল সে’খেয়াল আছে?
-আরে তোমার কোন আইডিয়া নেই।রাজশেখর বসুর নাম শুনেছ, মানে সাহিত্যিক পরশুরাম, প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় চল্লিশ বছর বয়সের পরে, যোশেপ কনার্ড বেচারা কুড়ি বছর পর্যন্ত ইংরাজি ভাষাটাই ভালো করে জানত না।
–ঐ সব বলে কিছু হয় না।তোমার এই লেখার চক্করে বাপ্পা ঘর ছাড়ল।
-ওসব হয় হয়, জিনিয়াসদের প্রথম প্রথম কেউ বুঝতে পারে না।
-জিনিয়াস না হাতি।এই তো সেদিনও একটা খাতা জেরক্স করে একগাদা টাকা খরচ করলে,পাবলিশার্সদের কপি দিয়েও এলে। কেউ নিল? মাস তিন পেরিয়ে গেছে, কেউ একবার ফোন পর্যন্ত করল না।
-শোন ‘কুলি’, ‘আনটাচেবল’ এই সব ক্ল্যাসিক উপন্যাসের লেখক মুল্ক রাজ আনন্দের একটা পাণ্ডুলিপি পঁচিশবার রিজেক্ট হয়ে ছিল, আর ভদ্রলোক নিজে চারবার সুইসাইড করতে গেছিলেন। আমার তো সবে তিনচারটে হল। সুইসাইড অ্যাটেম্টও করিনি।
-তোমার জ্বালায় এবার আমাকে সুইসাইড করতে হবে।
বিয়ের পরে অবশ্য প্রথম প্রথম সুপ্রতীককে বেশ ভালো লাগত, শ্রদ্ধাও হত। একবার চন্দনার বড়দির শ্বশুর বাড়ির একজনের সাথে সুপ্রতীক বেমালুম তর্কে জিতে যায়।কোথা থেকে একটা বই এনে দেখিয়ে দেয়,‘বিদ্যাসাগরের আসল বাড়ি হুগলি জেলার বনকালীপুর গ্রামে।’ তার মুখের সামনে বলেও দেয়, ‘আপনার মত বিদ্যাসাগরের ঠাকুরদাও ঘর জামাই থাকতেন।’
অন্ধকার ব্যালকোনিতে সুপ্রতীককে ওরকম ভাবে দেখে চন্দনার দুটো চোখে বিপরীত ছবি ভেসে বেড়াতে আরম্ভ করে।এর আগে অবশ্য নিজের মনেই মাঝে মাঝে কি সব বিড় বিড় করে বকত।সেটা বাপ্পাও লক্ষ্য করেছে। কিন্তু এরকম ভাবে অন্ধকারও যে কোন দিন আঁকড়ে ধরতে পারে ভাবতে পারেনি।তারপর আস্তে আস্তে পিঁয়াজের খোসার মত এক এক করে সুপ্রতীকের সব স্তরগুলো খুলে যেতে আরম্ভ করতেই চন্দনার খুব ভয় করতে লাগল। ডাক্তার দেখানোর আগে একবার বাপ্পার সাথে কথা বলতেই ওদিক থেকে কথার ঝাঁজ সহ্য করতে হয়, ‘ঠিক হয়েছে, আমি তোমাকে অনেকদিন ধরেই বলে আসছিলাম, অত লেখা লেখা বলে মাথায় তুলো না, এবার বোঝ। ইট ইস অ্যান অবসেশন। তুমি ভাবতে পারো যে লোক ছেলের কলেজের গার্ডিয়ানডেতে ওরকম করতে পারেন তিনি সব পারেন। সেদিনের পর থেকে আমার বন্ধুদের কাছে আমার প্রেস্টিজ বলে কিছু থাকল না।বন্ধুরা পর্যন্ত আমাকে খ্যাপাকবির ব্যাটা বলে ডাকত। তুমিও তেমন, বাইরের দেশ হলে কবে ওরকম লোককে ছেড়ে চলে আসতে।’
সুপ্রতীকের কিছু কাজ চন্দনার নিজের ভালো না লাগলেও বাপ্পার এই সমস্ত কথাগুলো চন্দনার ঠিক ভালো লাগেনি। সুপ্রতীক একটু খেয়ালি হলেও চন্দনাকে তো কোনদিন কোন অবহেলা করেনি, যখন যা বলেছে শোনবার চেষ্টা করেছে, কিছুতে বাধাও দেয় নি।
তিন.
-আচ্ছা ওনার ঠিক একটাই সমস্যা? মানে কোনদিন এরকম তো হয় নি যে হঠাৎ খুব গেলেন, কাউকে যা ইচ্ছে বলে দিলেন।
-কয়েকবার টুকটাক ঘটনা হয়েছে, আমি সব বলছি।তাছাড়া উনি যথেষ্ট শান্ত প্রকৃতির মানুষ।এমনকি ওর অফিসের স্টাফেরাও খুব নাম করত।আমাকে বলত, ‘বৌদি আপনি প্রতীকদাকে কি খাওয়ান? কোন রাগ নেই। যা বলি হেসে উড়িয়ে দেয়।’
-কোন দিন কারোর উপরে রাগ দেখান নি।
–না, তবে কিছু ছেলে মানুষি করত। যেমন ধরুন ও একবার বিবাহবার্ষিকীর মিষ্টি কিনে টিফিন বক্সে ভরবার কিছু সময় পরেই একটা নামিয়ে দেয়।জিজ্ঞেস করাতে বলে, ‘প্রকাশকে দেবো না, ব্যাটা গল্প শোনে না, বলে কিনা আমি গল্প লিখতে পারি না।কিছুক্ষণ পর অবশ্য আবার নিজের থেকেই মিষ্টিটা টিফিন বক্সে ভরে নেয়।’
-তার মানে লেখা গল্প কেউ না শুনলে ওনার একটু রাগ হত, সেটা সব সময় প্রকাশ করতেন না, তাই তো?
–ব্যাপারটা ঠিক সেটা নয়, ও এমনি তে খুব কম জনকেই নিজের লেখা শোনাত। বিশেষ করে বাপ্পা কাজ নিয়ে চলে যাওয়ার পর তো এক্কেবারে কাউকেই শোনাতে চাইত না।
–হ্যাঁ।
–ওকে শোনাত?
–মাঝে মাঝে। তারপর একবার কলেজে সমস্যা হল, বাপ্পা রেগে গেল ?
–ঠিক কি রকমের সমস্যা হয়ে ছিল?
–ভারি অদ্ভুত সমস্যা। একবার এক গার্ডিয়ান মিটিংএর সময় কোন এক স্টুডেন্টের মায়ের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কি সব বলে ওঠে, পরে শুনি তাকে নাকি বলেছে, ‘আপনাকে অনেকটা মামণির মত দেখতে।’
–মামণি কে?
-ওর কোন এক গল্পের একটা চরিত্র। একটা অবৈধ সম্পর্কের ওপর গল্পটা। সুপ্রতীক তারপর সবাইকে গল্পটা শোনায়।এটাতেই বাকি সবার কাছে বাপ্পা এমব্যারেস্ট হয়ে যায়, তার একমাসের মধ্যেই ঘর ছাড়ে হোস্টেলে থাকতে আরম্ভ করে, তারপর এখন আবার এক্কেবারে রাজ্য ছাড়া।
–আপনি আপনার ছেলেকে কোনদিন কিছু বলেন নি?
–ওর শরীর খারাপের কথা বলেছিলাম। উত্তর দিল, ‘এখানকার ঘর বাড়ি বিক্রি করে ওর কাছে চলে যেতে।’
–বেশ, এবার একটা পুরানো কথা জিজ্ঞেস করব। উনি কি ছোট থেকেই লেখালেখি করেন?
-না খুব ছোট থেকে নয়, ঐ কলেজ পড়বার সময়। তবে চাকরির চক্করে সব কিছু ভুলেও যায়। অফিসের মিত্রদা নামের একজন লেখালেখি করতেন।আগে অন্য জায়গায় ছিলেন পোস্টিং হয়ে প্রতীকের অফিসে আসেন, আর তাঁর সাথে আলাপের পরেই সুপ্রতীক আবার লিখতে শুরু করে।
–কি লিখতেন কবিতা না গল্প ?
– দুটোই। মাঝে মাঝে প্রবন্ধও লিখত।
–প্রবন্ধ!
–হ্যাঁ। আমাকে পড়ে শোনাত।
–তার মানে উনি পড়াশোনা করতেন।
–অফিস থেকে এসে বই নিয়েই বসে থাকত। এমনকি বাজার যেতে বললে বোঝা যেত বিরক্ত হচ্ছে।
–আবার কবে থেকে লিখতে আরম্ভ করলেন?
–কবে থেকে হবে? বাবু তখন হায়ার সেকেন্ডারিতে পড়ে। তারপর বাবু কলেজের থার্ড সেমে চাকরি পেল, প্রতীক তারপরেই বলতে আরম্ভ করল, ‘অফিস থেকে রিটায়ার্ডমেন্ট নিয়ে শুধু লিখবে।’
–কিন্তু আপনি যে বললেন ওনার লেখা কোন বড় পত্রিকাতে প্রকাশিত হত না।
–বড় পত্রিকায় প্রকাশিত না হলেও লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হত। প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় যেতেন, বাড়িতেও অনেকে আসতেন, কিন্তু এই বাজারে যে সব ম্যাগাজিন চলে সেগুলোতে কোন লেখাই প্রকাশিত হয় নি। এমনি কি একই গল্প কখনো নিজের নামে কখনো বা আমার নামে পাঠাতেন।
–তাই! কেন?
–ওনার কোন বন্ধু ওনাকে বলেছিলেন, ‘বড় পত্রিকার হাউসে মহিলা রাইটারদের কদর বেশি থাকে।’ কিন্তু তাতেও প্রকাশিত হয় নি।
–বেশ। তার মানে ওনার সমস্যার সূত্রপাত ঐ রাতের বেলা বিছানা থেকে উঠে লিখতে বসা বা ব্যালকোনিতে বসে থাকার হাত ধরেই?
–না, এর আগে উনি চুপচাপ বসে থাকলেই বিড় বিড় করে বকতেন।
–কি বলতেন ?
–প্রথম প্রথম শুনতাম না। পরে শুনলাম, ওনার নিজের গল্পের চরিত্রগুলোর সাথেই কথা বলতেন। মানে সব গল্প গুলোই তো আমাকে পড়াতো, সে থেকেই বুঝতাম।
–তখন কোন সাইক্রিয়াটিকের সাথে কনসাল্ট করেননি ?
–করেছিলাম। প্রথমে ও বুঝতে পারেনি। পরে বুঝতে পেরে ডাক্তারবাবুকেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন করতে আরম্ভ করন।
–আমার মাথায় ঐ সব ঢুকত না, কিসব ফুকো, দেরিদা এই সব নিয়ে আলোচনা করত।
–বাড়িতেও ?
–মাঝে মাঝে একটা লাইন বলত, ‘মাটির সাথে মাটি মিশে যায়, কিন্তু ইটের সাথে ইট কখনো মেলে না।’
-আর?
-আর বলতে প্রায় আমাকে অভিনয় করতে হত।
–কিরকম?
-ওর মনে হত সবাই ওর সাথে দেখা করতে এসেছে, আমাকে চা তৈরী করে দিতে বলত।
–আপনি করে দিতেন?
-আমি কাপ ডিশে জল নিয়ে ওর কাছে নিয়ে যেতাম।ও ওর গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে কথা বলত, চা খেতে বলত, কাউকে আবার টিফিন খাওয়ার জন্য বলত। আমাকে তাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিত।না রেসপন্স করলে রেগে যেত।
–ওনার অফিসের কলিগদের সম্পর্কে আপনি কি জানেন একটি বলুন, মানে অফিসের মহিলা কলিগদের সাথে ওনার কি রকম সর্ম্পক বলতে পারবেন?
–দেখুন ও এমনি তে একটু চাপা স্বভাবের, আর অফিসের কোন মহিলা কলিগের সাথে কোন বিশেষ ধরনের সম্পর্ক থাকলে একটা তো ছায়া পড়বে, না সে সব কোন দিন কিছু বুঝতে পারিনি। কোন দিন পুরুষ কলিগদের সর্ম্পকেও সেরকম বিশেষ কিছু কোন দিন বলেনি।
–এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা করি। আপনার সাথে ওনার সম্পর্ক কেমন ?
–স্বামী স্ত্রীর যেমন হয়।
–লাস্ট কোথায় ঘুরতে গেছিলেন ?
–লাস্ট বড় ট্যুর বলতেও সেটা বছর সাত আট আগে। সিকিম। তারপর প্রতি বছর অফিস ট্যুর হয়েছে, তবে কাছে পিঠে।
–আপনারা একই রুমে শোন তো ?
–হ্যাঁ।
–একই বিছানায় ?
–অবিয়াসলি।
–লাস্ট রেলেসিনশিপ ?
–আমাদের তো সেরকম কোন সমস্যা নেই।
–আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। আমার একটি ডিটেলিং প্রয়োজন। আপানদের একটিই সন্তান ?
– হ্যাঁ।
–বিয়ের ঠিক কত বছর পর হয়।
–বছর দুই।
–সেকেন্ড ইস্যুর জন্য ট্রাই করেন নি ?
–না।
–কেন ?
–আসলে আমাদের দু’জনের ব্লাডগ্রুপ এক। শুনেছিলাম সেকেন্ড ইস্যু হলে পোলিও বা অন্য কোন রোগ হয়ে যেতে পারে তাই সাহস করিনি।
–আপনাদের ফিজিক্যাল রিলেসনশিপ কি তার পর থেকে রেগুলার, মানে টিল নাও ?
-( একটু চুপচাপ) নট নাও।
–কত দিন ধরে ধরে ইরেগুলার ?
–বছর তিন চার।
–ভেবে বলুন।
–পাঁচ বছর।
–এরপর ডাক্তার সেন আর কোন কথা না বলে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন। উল্টোদিকের চেয়ারে বসে থাকা চন্দনা এক ভাবে ডাক্তার সেনের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঘরটাতে একটাই জানলা, জেব্রা পলিয়েস্টার ঝুলছে, চন্দনা নিজের সারা গায়ে ওরকম সাদা কালো দাগ দেখতে পেল। জানলার ওপাশে কি আছে? শহরের ভিতরে একটা মরূভুমির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেল। সুপ্রতীক হাঁটছে, হেঁটেই যাচ্ছে।
‘একাকিত্ব আর দুর্বলতা তূলনামূলক বেশি কল্পনার জন্ম দেয়, বলতে পারেন ভীতু মানুষও, যেটুকু শুনলাম তাতে মনে হল উনিও খুব ভীতু, লেখাটা তার কাছে একটা অবশেশন। এটা ভালো কিন্তু একটু সাবধানে রাখবেন, এই সব মানুষের একটু সুইসাইডের টেনসেন্সি আছে।’
চেম্বার থেকে বাইরে বেরিয়েও ডাক্তারবাবুর বলা শেষ কথাগুলো মাথার মধ্যে হিজিবিজি কাটছিল। সুপ্রতীক কি সত্যিই ভীতু? বিয়ের পর কোন দিনই কোন রকম অ্যাগ্রেসন দেখায় নি এটা ঠিক কিন্তু বাপ্পাও তো জন্মেছে।ও জন্মানোর পরও? না কোন কিছুই নিয়মিত হয় নি। তাদের জীবন অফিস, বাপ্পার স্কুল, কয়েকজন আত্মীয়ের মধ্যেই চড়কি খেতে আরম্ভ করে।রাতে দুজনের এক বিছানার মধ্যে কোন গ্যাপ না থাকলেও বাপ্পা ছিল।
বাসের জানলার পিছনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সবকিছুর সাথে নিজেকে এক করবার সময় সুপ্রতীকের লেখা পাণ্ডুলিপির পাতাগুলোও উড়তে লাগল।পিছনে ছুটছে সুপ্রতীক, একটা বাসের স্টপেজের ওয়েটিং রুমে বাপ্পা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। চন্দনার খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করল, ‘তোর বাবা ছুটছে, তোর বাবা ছুটছে।’ হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি লাগল। ‘এই রে বাপ্পা যদি ডাক্তারের কথা জিজ্ঞেস করে? মানুষটাও বা এতক্ষণ ধরে কি করছে কে জানে?’
চার.
কোথাও বাইরে গেলে আজকাল চন্দনা পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চা ছেলেটাকে সুপ্রতীকের কাছে বসিয়ে দিয়ে আসে। বড়ছেলেরা কেউ ওর কাছে বসে না, বলে ‘জেঠু খুব বকে, কিচ্ছু বুঝি না।’ সুপ্রতীক আবার এই বাচ্চাটকে খুব পছন্দ করে। নামটিও বেশ, বুমকা, প্রায় ওর জন্য চকলেটও নিয়ে আসে।
চন্দনা তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলতেই ভিতরের অন্ধকারটা কেমন যেন টালমাটাল করে দিল। ঘরটা এক্কেবারে শূন্য। কোন মানুষ যে এখানে থাকতে পারে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। চন্দনা একবার বুমকার নাম ধরে ডেকে কোন সাড়া না পেয়ে ঘরের আলো জ্বেলে ভিতরের ঘরে গিয়ে চমকে উঠল।তাহলে কি ডাক্তারবাবু যা বললেন সেটাই সত্যি হতে যাচ্ছে? হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করল। কিছু সময় পর বারান্দার আলোতেই দেখতে পেল ঘরের ভিতরে এক্কেবারে মাঝে সুপ্রতীক বসে আছে আর তার চারদিকে এক গাদা কাগজ পড়ে আছে।একটু শান্তি পেল চন্দনা, সুপ্রতীককের নাম ধরে ডাকতেই ঘাড় ঘুরিয়ে বলে উঠল, ‘ও তুমি এসে গেছ, আমি কিছু ক্ষণ আগে চা করতে বললাম।বিপাশা অনেকক্ষণ ধরে এসে বসে আছে।ওর মায়ের কি একটা অপারেশন হবে।কিছু টাকার দরকার, তাই ব্যাঙ্কের বইগুলো দেখছিলাম।তুমি কি আমাকে একটু হেল্প করতে পারো?’
চন্দনা কোন কথা না বলে আস্তে আস্তে সুপ্রতীকের পাশে বসে ওর মাথাটা টেনে নিজের বুকের মাঝে আটকে রাখতেই দু’চোখ দিয়ে টপ টপ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।বুঝতে পারল না ঠিক কি করা যেতে পারে। দু’হাতে মুখটা চেপে রেখে কিছু সময় বসে থাকতেই বাইরের দরজায় টোকা মারবার আওয়াজ পেল।দ্বিতীয় বার আওয়াজটা শুনে দরজাটা খুলতেই দেখল বাইরে বুমকার মা।চন্দনাকে দেখে এক গাল হেসে বলে উঠল, ‘বৌদি, দাদাকে কি খাওয়াচ্ছো গো, সেই দুপুর থেকে দেখো গে বাচ্চাদের সাথে খেলে যাচ্ছে।’
-কেন বুমকাদের সাথে, ঐ তো কমপ্লেক্সের পিছনের মাঠটাতে।তুমি তোমাদের ঐ’দিকের ব্যাকলোনিতে যাও দেখতে পাবে।চন্দনা আর কিছু না বলে হাসি মুখেই দরজাটা লাগিয়ে মুখ ফেরাতেই দেখল সোফাতে এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন।একটু অবাক হল চন্দনা, একি একই শাড়ি পরে আছে, অদ্ভুত তো। চন্দনার দিকে একভাবে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসতে দেখে রাগে গা পিত্তি জ্বলতে আরম্ভ করল।চিৎকার করে বলল, ‘হাসছেন কেন? হাসার কি আছে, আর কে আপনি?’
-সেটা নিজেকেই জিজ্ঞেস কর, অথবা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াও।
চন্দনা তাড়াতাড়ি বারান্দার আয়নার সামনে দাঁড়াতেই পিছনে একটা মিছিল দেখতে পেল সবার হাতে একটা করে প্ল্যাকার্ড।কারোর প্ল্যাকার্ডে লেখা অদিতি, কারোরটাতে সুমনা, কারোর বা জেসমিন।সোফার ভদ্রমহিলা এতক্ষণে চন্দনার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।তার হাতেও একটা প্ল্যাকার্ড, তাতে জ্বল জ্বল করছে চন্দনার নিজের নামটা।
লেখক: ঋভু চট্টোপাধ্যায়, গল্পকার, দুর্গাপুর, পশ্চিম-বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।