মানুষ- সমাজ

ইতালী থেকে বৃটেনবাসীর উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

নরসুন্দা ডটকম   এপ্রিল ২০, ২০২০
ইতালী

[ফ্রান্সেসকো মেলানড্রি : ইতালীর এই বিখ্যাত লেখিকা সম্প্রতি নিজ দেশের ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির মুখে নিজ শহরে তিন সপ্তাহ বন্দী অবস্থায় থাকার পর বৃটেনবাসীর উদ্দেশ্যে তাঁর অভিজ্ঞতা একটি খোলা চিঠির ধরণে লিখে জানিয়েছেন, অল্পকালের মধ্যে ঠিক যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সেখানকার বাসিন্দারা । গত ২৭ মার্চ লেখাটি  The Guardian এ প্রকাশিত হয়। ঘরোয়া ভংগীতে লেখা চিঠিখানা পড়ার পর মনে হলো বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে ভিনদেশী লেখিকার অভিজ্ঞতা ভাগ করি ; বিশেষত: একই কারণে আমরাও যেখানে এখন গৃহবন্দি । পাঠকের সুবিধার কথা ভেবে অনুবাদে সামান্য স্বাধীনতা নিয়েছি বলে লেখাটি “অনুবাদ” বা “ভাষান্তর” না বলে “বাংলা রূপান্তর” বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি- সৈয়দ কামরুল হাসান ]

আমি ইতালী থেকে লিখছি, তার মানে আমি লিখছি আপনাদের ভবিষ্যৎ থেকে। আমরা এখন যেখানে আছি অল্পকয়দিনের মধ্যে আপনারা ঠিক এখানটায় এসে পৌঁছুবেন। মহামারীর দৃশ্যমালা আমাদের সবাইকে একই মঞ্চে সামিল করেছে। সময়ের পথ-পরিক্রমায় আমরা আপনাদের চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে আছি, ঠিক যেভাবে উহান আমাদের চেয়ে কয়েক সপ্তাহ এগিয়ে ছিলো। আমরা এখন আপনাদের তাকিয়ে দেখছি; দেখছি আপনাদের প্রতিটি আচার আচরণ, আমাদের বেলায় যে সব দেখা গিয়েছিলো। অল্প কিছুকাল আগেও আমরা ছিলাম যুক্তির মাঝামাঝি একটা অবস্থানে। অর্থাৎ যারা বলাবলি করতো- “আরে এ আর এমন কি, এতো হৈচৈ-য়ের কি আছে, এতো নেহায়েৎ একটা ফ্লু”- তারা এবং যারা ইতোমধ্যে বুঝে গিয়েছেন বিষয়টি আসলে কি – এই দু’তরফের যুক্তির মধ্যে ব্যবধানসূচক যে মাঝামাঝি অবস্থান সেই জায়গাটায়। আপনারাও এখন অবস্থান করছেন যুক্তির এমন একটা মাঝামাঝি অবস্থানে।

আজ এই ভবিষ্যৎ অবস্থান থেকে আপনাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারছি, আপনাদের অনেকেই – যেহেতু আপনাদের সবাইকে এখন লকডাউনে যেতে বলা হয়েছে- অরওয়েল থেকে পাঠ করছেন, এমনকি অনেকে হবসকেও উদ্ধৃত করছেন। কিন্তু খুব শীগগীরই স্বেচ্ছানির্বাসনে আরো ব্যস্ত হয়ে উঠবেন আপনি, আপনারা।

প্রথমত: আপনি খাবেন, খেতে শুরু করবেন। শুধু এজন্যেই নয় যে, এটাই সবশেষ কাজ যা কিনা আপনি করতে পারছেন। কেননা অতি শীঘ্র আপনি সন্ধান পাবেন কমপক্ষে এক ডজন সামাজিক নেটওয়াকিং গ্রুপ, যাদের আছে অনেকগুলি টিউটোরিয়াল, যার মাধ্যমে অবসরের এই সময়টা আপনি দারুণভাবে ব্যয় করতে পারেন। আপনি খুব দ্রুত সবগুলিতে যুক্ত হবেন, আর তারপর কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের সবক’টিকে সম্পূর্ণ ভুলে যাবেন।
আপনি বুকশেলফ থেকে নামিয়ে আনবেন মহৎ সাহিত্যের বই, কিন্তু শীঘ্রই আপনি অনুভব করবেন এর কোনটই পড়ার আগ্রহ নাই আপনার। আপনি আবার কিছু খেতে শুরু করবেন। আপনার ভালো ঘুম হবে না। আপনি নিজেকেই শুধাবেন- গণতন্ত্রের কি হলো ! অনলাইনে আপনার সাক্ষাৎ ঘটবে এক বিরতিহীন সামাজিক জীবনের- ম্যাসেঞ্জারে, হোয়াটস অ্যাপে, স্কাই পি তে, জুমে—-

নিজের বয়োপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েদের কথা খুব মনে পড়বে আপনার- ‘আর কোনদিন দেখা হবে কি না জীবনে’- এমন একটা অনুভূতি বুকে এসে তীব্র আঁচড় কাটবে। আগের অভিযোগ ও ক্ষোভগুলি মনে হবে অবান্তর। কোনদিন ভাবেননি যার সাথে ডেকে কথা বলা যায়, এমন কাউকেই হয়তো আচমকা জিজ্ঞেস করে বসবেন -“কেমন আছেন, কেমন চলছে দিনকাল?”

অনেক নারী গৃহে মারধোরের শিকার হবেন। আপনি তাদের অবস্থার কথা ভেবে আশ্চর্য বোধ করবেন যাদের থাকার জন্য কোন ঘর কিংবা আশ্রয় নাই। ফাঁকা রাস্তায় শপিংয়ের জন্য বেরিয়ে আপনি বিপন্ন বোধ করবেন, বিশেষত: আপনি যদি নারী হয়ে থাকেন। আপনি নিজেই নিজের কাছে জানতে চাইবেন- এভাবেই কি কোন একটা সমাজ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে? এটা কি সত্যি সত্যি এত তাড়াতাড়ি ঘটে? আপনি এইসব চিন্তার আবরতে ঘুরপাক খেতে থাকবেন এবং অবশেষে যখন আপনি বাড়ি ফিরে আসবেন , আবার খেতে বসে যাবেন। আপনার ওজন বাড়বে। অনলাইনে ফিটনেস প্রশিক্ষণের খোঁজ করবেন আপনি।
আপনি হাসবেন। হ্যাঁ,প্রচুর হাসবেন আপনি। হাসির গমকে দুলতে থাকবেন আপনি, এমন অভিজ্ঞতা আর হয়নি ইতোপূর্বে আপনার। এমনকি যারা সবসময় জীবনের প্রতিটি বিষয়কে খুব সীরিয়াসলি নিয়েছে, তারাও এই জীবনের অসারতা, এই বিশ্বব্রর্ম্মান্ডে যা কিছু আছে সবকিছুর অর্থহীনতা নিয়ে ভাবতে শুরু করবে।

বন্ধু এবং প্রিয়জনের সাথে সুপারমার্কেটের লাইনে দাঁড়ানোর এপয়েন্টমেন্ট করবেন আপনি, যাতে সামাজিক দূরত্বের সব নিয়মকানুন মেনেই, সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও চাক্ষুষ সাক্ষাৎ ঘটে। যে সব কিছু আপনার দরকার নাই, আপনি সেগুলি গুনতে শুরু করবেন। আপনার চারিপাশের লোকজনের প্রকৃত চরিত্র আপনার সামনে যেন স্বচ্ছ হয়ে ফুটে উঠবে। আপনি নিজের মধ্যে উপলব্ধি করবেন এর সম্মতি ও সমর্থন; কখনো আবার বিস্মিতও হবেন আপনি।

সংবাদে অষ্টপ্রহর উপস্থিত পন্ডিতসমাজ উধাও হবে, তাদের মতামতকে হঠাৎ মনে হবে অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক। কেউ কেউ যুক্তিগ্রাহ্য মতামতে আশ্রয় খুঁজবেন, যা কিনা সহানুভুতিতে অনুপস্থিত, ফলে যা আর মানুষ শুনবে না। বরং যাদের এতদিন উপেক্ষা করে এসেছেন, তারা হয়ে উঠবেন আপনার কাছে আস্থার প্রতীক, উদার, বিশ্বস্ত, বাস্তবানুগ এবং স্বচ্ছদৃষ্টিসম্পন্ন।

যারা এই জগাখিচুড়ি অবস্থাকে আমাদের এই গ্রহের নবজন্ম হিসাবে দেখার জন্য আপনাকে আমন্ত্রণ জানাবেন, তারা এ-সবকিছুকে একটা বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে দেখার জন্য আপনাকে সাহায্য করবেন। আপনিও বিপুল বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখবেন: আরে তাই তো, কী চমৎকার, আমাদের গ্রহটা কারবন নি:সরণ আদ্ধেকে নেমে আসায় ভালো করে এখন শ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু — !

কিন্তু আগামী মাসের বিলগুলি আপনি দেবেন কিভাবে? নতুন পৃথিবীর এই জন্মলগ্ন- আপনি ঠিক বুঝে উঠতে পারবেন না এ আপনার জন্য কতটা মহৎ আর কতখানি শোচনীয় একটা ঘটনা!

আপনি আপনার জানালা ও লন থেকে গান গেয়ে উঠবেন। আপনি যখন আমাদের গাইতে দেখেছিলেন আমাদের ব্যালকনীতে অপেরায়, তখন আপনি ভেবেছিলেন : “ আহা বেচারা ইতালীয় !” কিন্তু আমরা জানি, আপনারাও গাইবেন একে অপরকে চাঙ্গা করার জন্য। এবং যখন “আমি বেঁচে থাকবো” গাইতে গাইতে ফেটে পড়বেন আপনাদের জানালায়, আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো আর মাথা নাড়বো। ঠিক যেমন উহানের জনগণ যারা ফেব্রুয়ারিতে তাদের জানালায় দাঁড়িয়ে গাইছিল আর পরে আমাদের গাইবার সময় আমাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছিল। আপনাদের মধ্যে অনেকেই এই শপথ বুকে নিয়ে ঘুমুতে যাবেন- লকডাউন উঠে গেলে আপনার প্রথম কাজ হবে আদালতে তালাকনামা দাখিল করা

গর্ভে আসবে অনেক শিশু। আপনার ছেলেমেয়েরা অনলাইনে ক্লাশ শুরু করবে। কখনো তারা হয়ে উঠবে ভয়াবহ রকমের উপদ্রব, আবার কখনো আনন্দও দেবে আপনাকে। বয়স্ক মানুষজন দুর্বিনীত হয়ে উঠতে পারে টিনএজারদের মত। তারা বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইবে; বেরিয়ে গিয়ে সংক্রমিত হওয়া আর মৃত্যুবরণ করার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের সঙ্গে রীতিমত লড়াই করতে হবে আপনাকে। আপনি চেষ্টা করবেন আইসিইউতে নি:সঙ্গভাবে মারা যাচ্ছেন- এই চিন্তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে। সকল স্বাস্থ্যকমীর পদচ্ছাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ইচ্ছা হবে আপনার।
সকলেই বলাবলি করবে, আমাদের সমাজ একটা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, আমরা এখন সবাই একই নৌকার যাত্রী। এটা মনে হবে সত্যিকার একটা উপলব্ধি। এধরণের উপলব্ধি আপনি যে বিশাল সমগ্রের এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা সে-চেতনায় আপনাকে চিরতরে পাল্টে দিতে পারে।

কিন্তু হ্যাঁ শ্রেণী, শ্রেণীই করবে বিভাজন। সুরম্য বাগানসমেত একটি বাড়িতে বন্দি থাকা আর জনবহুল কোন আবাসিক ভবনে বন্দি হয়ে-থাকা – এ-দুয়ের অভিজ্ঞতা এক হবে না। একই রকম হবে না বাড়িতে বসে কাজ করা আর চাকুরীচ্যুত হয়ে ঘরে বসে থাকার অভিজ্ঞতা। সেই নৌকাটি, যাতে চড়ে আপনি করোনা মহামারিকে পরাভূত করার জন্য সকলের সাথে একযোগে পাড়ি দিয়েছেন, তা প্রত্যেকের জন্য দেখাবে না একই রকম। আসলে তা প্রত্যেকের জন্য একই রকম নয়ও; কোনোকালে ছিলোও না !

এক পর্যায়ে আপনার মনে হবে এটা বেশ জটিল একটা ব্যাপার। আপনি ভয়ে শিউরে উঠবেন। আপনি প্রিয়জনকে আপনার ভয়ের কথা জানাবেন, কিংবা প্রিয়জনের উপর ভয়ের ভার চাপিয়ে না দিয়ে ভয়টুকু নিজের মধ্যেই রাখবেন। আবার আপনি খেতে বসবেন। আমরা ইতালীতে বসে এভাবেই দেখছি আপনাদের ভবিষ্যৎ। কিন্তু এটা ভবিষ্যৎ দেখবার একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র আমাদের দিক থেকে। আমরা ততটা দূরদশী নই।

যদি আমরা আরো দূরে তাকাতে যাই, ভবিষ্যতের দিকে – যা একইসাথে আপনাদের, আমাদের সকলের কাছে অজানা – সে-ক্ষেত্রে এটুকুই শুধু আপনাদের বলতে পারি: একদিন যখন এ-সব কিছুর অবসান ঘটবে, পরিচিত আমাদের এই পৃথিবীটা ঠিক এমনটি আর থাকবে না

[ফ্রান্সেসকো মেলানড্রি :১৯৬৪ সালে রোমে জন্মগ্রহণকারী এই লেখিকা একই সাথে একজন ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্যকার ও প্রামাণ্য চিত্রনিমাতা। তাঁর তৈরি অনেকগুলি প্রামাণ্য চিত্র পুরস্কৃত হয়েছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস Eva Sleeps/Eva Dorme অনেকগুলি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়। ২০১২ সালে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস Piu alto del mare বিখ্যাত Rapallo Carige Prize লাভ করে ]

আরো পড়তে পারেন…..

করোনা ডায়েরি: কেমন আছে আমার অন্য দেশের বন্ধুরা?

করোনায় চার দেয়ালে বন্দী শিশুর জীবন!

শারীরিক দূরত্ব না সামাজিক দূরত্ব? – তাপস দাস

About the author

নরসুন্দা ডটকম