বই আলোচনা সাহিত্য

বেবী নাজ করিম এর ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা‌- শওকত কবির কাজল

নরসুন্দা ডটকম   এপ্রিল ১৫, ২০২১

বেবী নাজ করিমের পৈতৃক নিবাস কিশোরগঞ্জ জেলায়। পেশায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। তাঁর সদ্য প্রকাশিত দ্বিতীয় গল্পের বই ‘সম্পর্ক ’।

নীলাচলে অনূঢ়া, সম্পর্ক, সীমানা, ফিকে নীল ওড়না ও ইলিশ মাছের মুড়ো মনস্তাত্তিক ঘরানার এ-ই পাঁচটি পরিচ্ছন্ন ছোটগল্প গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে।
সৌভাগ্যক্রমে লেখিকা কলেজ জীবনে আমার সহপাঠী ছিলেন। তাই প্রবল আগ্রহে বইটি হাতে পেয়েই পড়তে শুরু করি এবং পাঠ প্রতিক্রিয়াও পেশ করলাম খুব দ্রুততার সাথে…

আমি আবার একটু ব্যতিক্রমী পাঠক। বিশেষত ছোটগল্পের শুরু ও শেষের কিছুটা আগে পড়ে নেই। দেখি শেষ হইয়াও শেষ হইলো কিনা। কেন না কবিগুরুর সেই যে কয়েকটি লাইন ছোটগল্প বিষয়ে পড়েছিলাম সেটাকেই সঠিক মানদণ্ড বলে আমি এখনো মেনে চলি যদিও এখন তা সঠিকভাবে পালন করা হয় কিনা তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক থাকতেই পারে।

‘নীলাচলে অনূঢ়া’ গল্পের শেষ দিকে দেখা গেল তেমনি একটা চমক। গল্পের নায়িকা প্রথা’র পরনে আকাশনীল শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে, উড়ন্ত অবাধ্য চুল, আর সবাইকে সে জানাচ্ছে মনোলগে ‘সবাই শোন আমি এক নীলাচলের অনূঢ়া বলছি। আমি কাউকে ফিরিয়ে দিতে পারি।’
এই যে ফিরিয়ে দেওয়ার মাঝেও শান্তি ফিরে পাওয়া যায় সেটাই আমাকে আগ্রহান্বিত করে তোলে পাঠে এবং অন্যান্য পাঠকগণও গল্পটা শুরু থেকে শেষ করলেই বুঝতে পারবেন সহজেই।আমিতো মুগ্ধ হয়েছি এ কারণে যে কী এক অপার রহস্য নারীর জীবন যাপনে আর জাগরণের মাঝে যা ধাওয়া করছে তাঁদের মনোজগতে যুগ যুগ ধরে…!

তবে শুধু অবলা নারীগণই কেন শ্রেণী ও বর্ণ বৈষম্যের যাঁতাকলে পিস্ট বহু নরগনও দিনাতিপাত করে যাচ্ছে সারা বিশ্বজুড়ে এমন অবদমিতমনে।হয়তোবা প্রথার মতো ফিরিয়ে দেয়ার শক্তি সঞ্চয় করে একদিন তারাও বিজয়ের হাসিতে ঝলসে উঠবে এ বিশ্বাস জন্ম দিয়েছে গল্পটিতে।জয়তু লেখিকা।

‌‘ভোর রাতের দিকে হিমায়িত এ্যাম্বুলেন্স উপরে ঘূর্ণায়ন লাল বাতি জ্বালিয়ে পে-পু, পে-পু শব্দ তুলে সবে বাড়ির ভেতর ঢুকলো’ দ্বিতীয় গল্প ‘সম্পর্ক’ এমন নাটকীয় ভাবেই শুরু আর আমার মতো উৎসুক পাঠকদেরকেও ঢুকিয়ে দিলেন গল্পের ভেতর। প্রবাসী কন্যা ইলা এসেছে মায়ের অসুস্হতার খবর পেয়ে বাবার বাড়িতে। কিন্ত কোন নোটিশ ছাড়াই তরতাজা তার মা এমন হঠাৎ করে চলে যাওয়া, তার শোকাতুর অসুস্থ বৃদ্ধ বাবার কাছে গিয়েও তার সাথে কোন বাক্যলাপ না করে ফিরে আসা, অতীতে জীবনকে পিছন ফিরে দেখা আর কাজের মেয়ে কমলার সাংসারিক দায়িত্ব নেয়া এ-ই সব নিয়েই ইলার মনোজগতের দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে গল্পটি। শেষমেশ বাতাসের ধর্মের মতো কোথাও খালি রাখে না কোন ফাঁক ফোকর সব পূরণ হয়ে যায় তেমনি ভাবে কমলার হাতেও চলে আসে সংসারের চাবি।এ-ই যে একটা শ্রেণীর প্রবাসে চলে যাওয়া আর এক শ্রেণীর উত্থান ঘটছে সমাজে নিভৃতে ঘরে ঘরে তারই নিঁখুত বর্ণনা দিয়েছেন গল্পটিতে। সত্যি সম্পর্কের কতো বিচিত্র জালে যে জড়িয়ে যায় মানুষ!

হাল আমলের ভার্চুয়াল জগতের প্রেম কাহিনি নিয়ে তৃতীয় গল্প ‘সীমানা’। আমরা যারা এসব জগতে বিচরণ করছি তাদের কমবেশি এ অভিজ্ঞতা আছে বলেই আমার ধারণা। তবে লেখিকা বেশ বিশ্বাসযোগ্য ভাবেই বিস্তীর্ণ ও সীমানার চেটিং বিবরণ পেশ করেছেন দক্ষতায় এবং শেষটা চরম নাটকীয়তায় সুতরাং গল্পটি অনেকের পছন্দ হবে এবং ভাসাবে আনন্দ-বেদনার দোলায় এটা নিশ্চিত ভাবেই বলে দিতে পারি।

চতুর্থ গল্প ‘ফিকে নীল ওড়না’ মনস্তাস্তিকতায় বেশ ভালো ভাবে উতরে গেছে বলে মনে হলো গল্পকার। তাঁর সব গল্পই নারী প্রধান কিন্তু এ গল্পে একটা সদ্য কৈশোর পেরনো ছেলে অনু’র মনোজগতে তিনি বিচরণ করেছেন প্রবল মুন্সিয়ানায়। বাস্তবতার গন্ধ লেগে আছে গল্প জুড়ে ।

গল্পটি পড়তে পড়তে আমার মনও জেগে উঠেছিল হঠাৎ কবেকার পুরনো এক কাঠেরপুলে যার উপর দিয়ে হেঁটে যায় কম্পিত পায়ে হালকাপাতলা গড়নের এক দুধসাদা মেয়ে তার আবছা মুখছবিটি যেনো সাদা পাল তোলা ছিপ নৌকার মতো ভেসে যায় নরসুন্দার জলে ঢেউ তুলে তুলে …!

শেষ গল্পটি ইলিশ মাছের মুড়ো। লেখিকাই বলেছেন এটি রম্য গল্প তবে তিনি পুরনো দিনের একান্নবর্তী পরিবারের একটি পূর্নাঙ্গ চিত্রই এঁকেছেন ছোটগল্প আকারে। বিশেষত প্রধান চরিত্র নতুন বৌ বিনুর মানসিক যন্ত্রণাটুকু।অনেক চরিত্রের ভিড় গল্পে সবগুলোকে নিয়ে একটা মজার কান্ডের মাঝে বিনুর মুখে একটু মিষ্টি হাসির ঝিলিক দিয়েই শেষ করেছেন গল্পটি। মুচকি হাসির সেই রেশটুকু রয়ে গেলো আমার মনে!

পরিশেষে বলতেই হয় ছোটগল্প লেখকের স্বচেতন সৃষ্টি। তা এক বিশেষ গঠনরীতি, বিষয়বস্তু, চরিত্র সৃষ্টি, কথোপকথন,পরিবেশ ও বাণীভঙ্গি ইত্যাদির প্রতি দৃষ্টি রেখে লিখতে হয় এবং লেখিকা সে দিকে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন।তবে প্রচ্ছদটি কেমন যেন সরল সিনেমাটিক হয়ে গেছে একটু শৈল্পিক হলে লেখার সাথে মানিয়ে যেতো আরও বেশি।

সবচেয়ে ভালোলেগেছে সর্বত্র লেখিকার পরিচ্ছন্ন মানসিকতার দরদী ছোঁয়া দেখে। আমরা তাঁর নিকট হতে আরও অনেক নতুন নতুন গল্পের প্রত্যাশায় থাকলাম। শুভকামনা রইল লেখিকার জন্য।

সম্পর্ক- বেবী নাজ করিম
প্রকাশক-ভবো রঞ্জন বেপারী
নন্দিতা প্রকাশ, ৩৬ বাংলাবাজার, ঢাকা – ১১০০
প্রকাশকাল- স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, ২৬ মার্চ ২০২১
প্রচ্ছদ- অনুপম কর
পৃষ্ঠা- ৮০টি
মূল্য- ২০০ টাকা
ISBN 9789845172455

আরও পড়তে পারেন….

আলিফ আলম এর গল্প- অপ্রাপ্তি

খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চায় যেভাবে সাজাতে পারেন আপনার দিনলিপি

সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে হবে ।। তাহ্ নিয়া কাদের

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

পড়ুন নদী বিষয়ক পত্রিকা রিভার বাংলা

প্রচ্ছদ

 

About the author

নরসুন্দা ডটকম