ঊর্মিলা কোনও দিন রাক্ষস দেখেনি। যখন শহরে ঝি-এর কাজ করত, একবার সন্ধের পরে সে একটা ভূত দেখেছিল। দালান না-ওঠা জমির কচুর জঙ্গলে নয়, সে দেখেছিল ওই জমি ঘিরে রাখা পাঁচিলের উপর একটা গলাকাটা ভূত হেঁটে বেড়াচ্ছে।
মাদকতা মাখা চৈত্রের শেষ শুক্রবারের সন্ধ্যায় সে দোকান থেকে কিছু কিনে লাইনের ধারের রাস্তা দিয়ে ফিরছিল। চৈত্র-সন্ধ্যার অন্ধকার পড়ে ছিল রাস্তার যে-বাঁকে, সেই বাঁক পেরনোর সময় সে দেখল, একটা লোক বা-দিকের পাঁচিলের উপরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। গা ছমছম করে ওঠার পরমুহূর্তে বিস্মিত ঊর্মিলা এক লহমা দেখতে পেয়েছিল, লোক নয়, ওটা একটা গলাকাটা ভূত।
তারপর সে আর শহরে থাকেনি। শহরের লোকেরা ভূতের কথা না-ও বিশ্বাস করতে পারে ভেবে সে কাজ ছেড়ে চলে আসার অন্য কারণ না জানিয়েই সটান গ্রামের বাড়িতে চলে আসে।
ঊর্মিলার ছেলে তখন বাসে হেল্পারি করত। গ্রামের বাড়িতে থাকত ছেলের বউ আর তাদের দুই মেয়ে।
ঊর্মিলা একটা ছোটো পা নিয়ে জন্মেছিল বলে সে যখন হাঁটত, দেখলে মনে হত, প্রতি পদক্ষেপে পিছলে যাচ্ছে। এখন লাঠি নিয়ে হাঁটার কালেও একই রকম মনে হয়। তা সত্ত্বেও রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আর পিছলে যেতে যেতেই সে সারা পাড়া ঘুরে বেড়ায়। বৃষ্টিভেজা রাস্তা কিংবা খটখটে পিচরাস্তায়— তার ভঙ্গিতে পরিবর্তন বোঝা যায় না। তবে, সে যে একটা ভূত দেখেছে এ-কথা কোনও মতেই সে স্বীকার করে না। এমনকী নাতনি মাম-এর কাছেও কোনও দিন ফাঁস করেনি।
অথচ, ভূত যে আছেই, আর ওদের গায়ের গন্ধ যে তার গায়ের গন্ধের মতো সেটা শুনে বেশ অবাক হয় ঊর্মিলা—
কে বলেছে তোকে?
মাম বলে, মা বলেছে।
কুরূপা ঊর্মিলা মামের দিকে করুণ চোখে তাকায়। পুনরায় বলে, মা বলেছে?
মাম বলে, তোমার গায়ে গন্ধ কেন ঠাক্মা?
রাস্তা দিয়ে একটা ইঞ্জিন ভ্যান চলে যাওয়ার শব্দে ঊর্মিলা কথাটা পুরোপুরি শুনতে পায় না; তবুও বলে, থাক। মা যখন বলেছে আসিসনে কাছে।
মাম চলে যায়।
ঊর্মিলা লাঠিতে ভর দিয়ে মাজা বেঁকিয়ে দাঁড়ায়। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে কিংবা পিছলে যেতে যেতে উঠোন পার হয়— রাস্তায় পড়ে। উপরে ইলেক্ট্রিকের তার— ল্যাম্পপোস্টের বাতি নিভে আছে। ঊর্মিলা দেখে, আকাশে একটু মেঘ। সে হাঁটতে শুরু করে।
তারপর একটু একটু করে দিন শেষ হতে থাকে। কেউ ঊর্মিলার খোঁজ করে না। অবশেষে রাত্রি ৯ টা ৪০-এ, ওরা কেউ তখনও ঘুমোয়নি— এমন সময় ঊর্মিলা বাড়ি ফেরে। বারান্দায় বাঁশের চটা-ঘিরে বানানো ঘুপচি ঘরে এসে ঢোকে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। কেউ তাকে খেতে ডাকে না। এবং রাত বাড়তে বাড়তে একটা একটা করে বাড়ির সবকটা বাতি নিভে যায়।
মাসখানেক ধরে এরকম চলছিল— খাবার চাইলে তবেই সে খাবার পেত।
তাই পরদিন বউমা ভুলে যাওয়ার আগেই সে ভাত চায়।
কিন্তু আপনারা জানেন না, প্রখর দৃষ্টিশক্তির অধিকারী ছিল ঊর্মিলা। ৭২ বছর বয়সেও তার চোখের জোর কমেনি।
গতদিন ছিল কার্তিকের তৃতীয় শনিবার। বাতাস রুক্ষ আর শীতল হয়ে উঠেছিল। কাজেই খালি পেটে শুয়ে শুয়ে ঊর্মিলা শিশির পতনের শব্দ শুনছিল। বাঁশের চটার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল বাইরের অন্ধকার আর মণ্ডল বাড়ির দোতলার আলো। মামের কথা সে ভোলেনি। তাই বার বার নিজের গা-এর গন্ধ শুঁকছিল। পরনের তেলচিটে কাপড়টার ওপর ঘন অন্ধকর। তক্তপোসের নীচে কয়েকটা আরশোলা চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে। একটা উড়ে এসে গায়ে বসল। সে ঝাড়া মেরে ফেলে দিল। তারপর ফের মণ্ডল বাড়ির দোতলার আলোর দিকে তাকাল। উঠোনের আম গাছে এক-দাপট বাতাস বয়ে গেলে ঊর্মিলা খুক খুক করে কাশল। ডিব্বা থেকে গুঁড়ো তামাকপোড়া আঙুলের ডগায় নিয়ে দাঁতে ঘসল। অনুভব করল, পোড়া তামাকের গন্ধ শুধু তার মুখে নয়, সারা ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে। ক্রমশ তার করোটির মধ্যে সেই গন্ধ গাঢ় কালো থেকে ধূসর হয়ে যেতে লাগল এবং অন্ধকারের ওপর শিশিরের ফোঁটা পড়ার দুটি শব্দের মধ্যে ব্যবধান বাড়তে বাড়তে অবশেষে শব্দ যখন একেবারে মিলিয়ে গিয়েছে, অমনি একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ঊর্মিলার।
তার গা ছমছম করে উঠল।
কীসের আওয়াজ! ভাবতে ভাবতেই আবার চমকে উঠল সে।
শেষ রাতের কুয়াশায় ভরে রয়েছে পৃথিবী। ঊর্মিলা নিঃশব্দে উঠে এল। দৃষ্টিশক্তির মায়াবী প্রাবল্যে পথ চিনে চলতে তার কোনও অসুবিধা হয় না। ফলে সে সন্তর্পণে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
আকাশে একটা ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ অস্ত যাচ্ছে। সেই চাঁদের আলোয় মৃদু হলুদ কুয়াশা ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। ঊর্মিলা সেই কুয়াশার আঁধারিতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল, পেছনের কলতলা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কেউ।
কে? ঊর্মিলা চিৎকার করে উঠল।
ছায়ামূর্তিটি পড়ি-মরি করে অন্ধকারে উধাও হতে চাইল।
ঠিক তখনই কলতলার দিকের বাইরের আলোটা এক মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠে দপ করে নিভে যায়।
খোঁড়া পায়ে ছায়ামূর্তিকে তাড়া করার ক্ষমতা ঊর্মিলার ছিল না। ফলে অন্ধকারের ধূসরতায় সে বিহ্বল বোধ করল। মুহূর্ত-আগের জ্বলে উঠে নিভে যাওয়া বাতির দিকে তাকাল একবার, তারপর তাকাল ছায়ামূর্তির পালিয়ে-যাওয়া রাস্তার দিকে। কিন্তু সে কাউকে ডাকল না। পেটের মধ্যে খিদে অনুভব করল বলেই হয়তো অন্ধকারে পিছলে যেতে যেতে ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়ল।
###
পেছনের বারান্দার এক কোণে বসে ভাত খেত ঊর্মিলা। শুনতে পেত, বউ আর দুই মেয়ে রান্না ঘরে বসে ভাত খেতে খেতে গল্পগুজব করছে। সেদিন নিমাই ডিউটি ছেড়ে বাড়ি এলে চার জন একসঙ্গে খেতে বসেছে।
ঊর্মিলা শুনল, নিমাই বলছে, কাল সারারাত ঘুমোওনি? চোখ-মুখের ও কী দশা!
বউ কোনও উত্তর দিল কি না ঊর্মিলা শুনতে পেল না। সে শুধু স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে চিৎকার করে বলল, রাত্রে বাড়িতে চোর আসে, এবং সে কাল রাত্রির ঘটনা বর্ণনা করতে যাবে, এমন সময় বউ-এর কথা তাকে থামিয়ে দিল।
বউ বলল, ঊর্মিলা আবার ভিক্ষে করতে গিয়েছিল।
ঊর্মিলা বলে উঠল, যাব-না কেন? না চাইলে ভাত দিতে ভুলে যাস! কাল সারারাত একটা মানুষ না খেয়ে থাকল— তোর হুশ ছিল না?
বউ বলল, দেখো দেখো…
ঊর্মিলা আঙুলের ফাঁকে জড়িয়ে যাওয়া মোটা-মোটা ভাতগুলোকে ছাড়াতে ছাড়াতে বিড়বিড় করার ঢঙে বলল, কাপালি পাড়ার বউরা আমাকে দেয়— ওদের খেতের জিনিস।
বউ বলল, না চাইতেই? হ্যাঁ,— মাগনা? কত আর মিথ্যে বলবি!
মিথ্যে বলা তোর গুষ্টির ধর্ম। মুখ খোলাস না বউ। বলল ঊর্মিলা।
নিমাই বলল, থামো। তোমায় আমি বারণ করিনি?
আজও যদি খেতে না দিত! — একটা মানুষ কি না-খেয়ে থাকবে? ফাটা গোড়ালির উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল ঊর্মিলা, ভাগ্যি করে তোরে পেটে ধরেছিলাম!
বউমা বলল, ভিখিরির ছেলে খেতে দেবে কী করে মাকে— বলো— শুনি—
ঊর্মিলা মনে মনে কিছু ভাবল, মুখে বলল ন।
###
আপনারা জানলে অবাক হবেন, এই ঘটনার ন-দিনের মাথায় ঊর্মিলার বাড়ির ভাত খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। তার একটা কারণ আছে।
একদিন মাম আর ঊর্মিলা একসঙ্গে বসে খাচ্ছিল। মামের পাতে ছিল এক টুকরো ডিমের অমলেট। শুধু টক ডাল দিয়ে ভাত খেতে খেতে ঊর্মিলার ডিমের অমলেটটার উপর খুব লোভ হয়। সে মামকে বলে, খেতে না পারলে মাম যেন নষ্ট না করে তাকে দেয়। মাম মাথা নাড়ে। সে আবার বলে, ডিমের অমলেট খেতে সে খুব ভালোবাসে। মাম এবারেও মাথা নাড়ে। তখন ঊর্মিলা বলে, এখন যদি সে একটু ভেঙে দেয়, সে পরে তাকে অনেক অমলেট খাওয়াবে। মাম আবার মাথা নাড়ে কিন্তু অমলেট ভেঙে দেয় না। ঊর্মিলা এরপর একটু ভেবে বলে, আমি জানি তুই আমাকে না দিয়ে খাবি না। মাম তখনও মাথা নাড়ে। উর্মিলা বলে, ওই দেখ, ওই পাখি। মাম পাখি দেখতে দূরে তাকায়। কিন্তু দেখতে না পেয়ে যখন জিজ্ঞেস করে, কোথায় ঠাক্মা? এবং দেখে, তার অমলেট অর্ধেক নেই, সে তৎক্ষণাৎ কান্না জুড়ে দেয়।
এই ঘটনার কারণে একটানা ২৪ প্রহর শাশুড়ি-বউমার ঝগড়া চলার পর যখন নিমাই বাড়ি ফিরে এসে বলল, এত লোভ তোমার? আর না। আজ থেকে নিজেরটা নিজেই করে খাও। তখন ঊর্মিলা মুখে কোনও কথা না বলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল নিমাই-এর দিকে।
অতএব, ঊর্মিলা কেজি সাতেক চাল জোগাড় করল। কপালি পাড়ায় যেত, বউ-ঝি-দের কিছু কিছু কাজ করে দিত; বদলে শুকনো বিট, শালগম, কুরুটে আলু আর ফুটে যাওয়া ফুলকপি ওরা দিত ঊর্মিলাকে। উঠোনের এক কোণে উনুন বানিয়ে সে এইসব রান্না করে খেতে লাগল। পাতা দিয়ে জ্বাল দিত— ধোঁয়া-ওঠা বন্ধ করতে না পেরে অসহায় হয়ে পড়লেও থেমে থাকত না।
নিজের লোকদের সঙ্গে কথা না বলেও ভালো থাকা যায়। বেশ কাটছিল ঊর্মিলার। কিন্তু বসন্ত এসে গেল। আর এল একটা খেঁকি কুকুর।
যেদিন আচমকা বৃষ্টিতে তার উনুনে জল ঢুকে গেল তার পরদিনই ওই কুকুর ঊর্মিলাকে মন্ত্রণা দেয়। ঊর্মিলা ছোটে কাউন্সিলারের বাড়িতে। একটা ত্রিপল চেয়ে আনে।
অচিরেই সেই খেঁকি তার আপন হয়ে ওঠে। হাড়গিলে শরীরে সারাদিন ঊর্মিলার উনুনের পাশে শুয়ে থাকে। দিনের বেলা যখন ঊর্মিলা কামরায় গিয়ে ঢোকে, সে থাকে সিঁড়ির নিচের ধাপে আর রাত গভীর হলে সন্তর্পণে ঊর্মিলার ঘরে ঢুকে যায়।
এর ফলে, ঊর্মিলা যা কোনও দিন জানত না— যেমন, বসন্ত জ্যোৎস্নার কাল— এ-কথা ও-ই শেখাল ঊর্মিলাকে। ঊর্মিলা বাঁশের চটার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না দেখল— মণ্ডল বাড়ির দোতলার আলোর দিকে আর চোখ গেল না। জ্যোৎস্নার পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে মৃদু বাতাস। অদূরের গ্রামে হরিনামের আসর বসেছে। ঊর্মিলা প্রাণভরে শুনতে শুনতে চোখ বুজল।
অচিরেই দুই চোখ ভেদ করে যখন তার করোটির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল হরিনাম, তখনও বাইরে বসন্তের বাতাস বইছে। চাঁদ জ্বলে রয়েছে আকাশে।
তারপর একটা আওয়াজ।
ঊর্মিলার ঘুম ভেঙে গেল। কী ভেবে সন্তর্পণে উঠে এল সে। খেঁকিটা তার সামনে সামনে চলল।
আগের দিনের মতো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখল ঊর্মিলা। কিন্তু কুক্কুরি তাকে বোঝাল: চোর না, ওটা রাক্ষস।
ভাবতে ভাবতে ঊর্মিলা ফের তার ঘুপচি কামরায় ফিরে এল। পৃথিবীতে বসন্তের শরীরে বাতাস খেলে বেড়াল, জ্যোৎস্নার শরীরে খেলে বেড়াল কাগজি লেবুর ফুলের গন্ধ। কিন্তু, রাক্ষস কেন আসে সে কিছুতেই ভেবে বের করতে পারল না।
পরদিন সকালে বসন্ত আরও চকচকে হয়ে উঠলেও বুড়ির মাথা থেকে রাক্ষসের ব্যাপারটা গেল না। তা সত্ত্বেও সে আলুর সঙ্গে শুকনো কুমড়ো ভাতে দিল এবং কাঁচকলা সেদ্ধ লঙ্কা দিয়ে মেখে পেট ভরে ভাত খেল। তারপর সারা দুপুর মড়ার মতো ঘুমোল এবং সন্ধে নাগাত ঘুম ভাঙল মাজার যন্ত্রণায়।
তার পরেও চলল বসন্তকাল। দিনের বেলা হৃদয়ের শিহরণ কাঁপিয়ে তুলল বনভূমিগুলোকে আর রাত্রিগুলোতে গোধূলি মুখ ঢাকতে শুরু করল চাঁদের আলোয়। উদ্দাম পৃথিবীর উচ্ছ্বাসে শিহরিত হল সবাই— এমনকী রাক্ষসও বাদ গেল না। আর সেই খবর একমাত্র জানতে পারল ওই বৃদ্ধ কুক্কুরী।
অথচ এই খবর সে ফাঁস করল না।
কিন্তু অচিরেই বসন্তকাল অপঘাতে মারা পড়বে একথা কেউ ভাবেনি। ভাবেনি, দু-একদিন পর থেকে অসহ্য গরম পড়তে শুরু করবে এই গ্রামে। ঊর্মিলার ঘরে কোনও ইলেকট্রিক ফ্যান না থাকায় গ্রামে ফিরে আসার পর থেকে এরকম রাতগুলো তার ঘুম আর জেগে থাকার মাঝামাঝি অবস্থায় কাটে। সে তালপাতার পাখায় হাওয়া খায়। পাখা চালাতে চালাতে তন্দ্রা এসে গেলে হাত শিথিল হয়ে পড়ে যায়। তখনই সে তামাকপোড়ার গন্ধ পায়— কলার বাসনা পোড়ানো ছাই আর রোদে শুকোনো তামাক পাতা মিশিয়ে বানানো তামাকপোড়ার গন্ধে তার তন্দ্রা ভেঙে গেলে সে তামাকপোড়া দাঁতের গোড়ায় নেবার পিপাসা অনুভব করে। কোনও কোনও দিন তামাকপোড়া ফুরিয়ে যাওয়ায় সে বিষণ্ন বোধ করে ফের পাখা চালাতে শুরু করে। তারপর অপেক্ষা করে দ্বিতীয় তন্দ্রার, অপেক্ষা করে স্বপ্নে পাওয়া গন্ধের।
তারপর একদিন আসে চৈত্রের শেষ বুধবার। রাত্রে গরমের চোটে হাঁসফাঁস করে সে। একগাদা চিতে কাঁকড়া খেয়ে তার শরীর আনচান করে। এমন সময় মনে হয়, পেছনের দরজা খোলার শব্দ শুনল সে। দেখল, কুকুরটাও নড়েচড়ে উঠেছে।
কীসের শব্দ?
কুকুর বলল, রাক্ষস ঢুকছে বউ-এর ঘরে।
বউ-এর জন্য ঊর্মিলার মায়া হল না। কুকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মরুক মাগি।
তারপর আর একটা আওয়াজ।
এবার গা শিরশির করে উঠল ঊর্মিলার। না, না; যত খারপই হোক— এভাবে রাক্ষসের হাতে…
সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল।
বাইরে রাত্রি আর্দ্রতাহীন নৈঃশব্দ্যে হাহাকার করছে। মণ্ডলবাড়ির দোতলার আলোটাও ক্লান্তিতে নিভু নিভু। অদূরে নিঃসঙ্গ শিকারী পেঁচা ডেকে চলেছে।
সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে অথচ শব্দ না করে এগিয়ে গেল। রাত্রির উষ্ণ ভাঁপ উপেক্ষা করেই সন্তর্পণে পিছনের দরজা ঠেলল। আশ্চর্য! দরজা খোলা! এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুড়মুড় করে বউ-এর ঘরে ঢুকে পড়ল ঊর্মিলা।
বউ জেগে আছে। এক বছর-তিরিশ-এর ছেলে তীক্ষ্ণ বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে ঊর্মিলার দিকে।
উর্মিলাও স্থির। সে জানে এ-ই রাক্ষস।
বউ বলে উঠতে যাবে, ‘তুমি!’ ঠিক সেই মুহূর্তেই ঊর্মিলা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, শালা রাক্ষস, তুই ওই পাড়ার সৌরভের রূপ ধরে এসেছিস?
ছেলেটি ভয়ে কেঁপে উঠলেও ঊর্মিলার তা দেখার দরকার পড়ল না। সে লুকিয়ে আনা বঁটির ফলাটা বের করে নাটকীয় ভাবে এগোতে শুরু করল।
রাক্ষস পালাতে গেল।
ঊর্মিলা কোপ চালাল। সেটা রাক্ষসের ডান বাহুতে সামান্য জখম করতে পারল অথবা পারল না। কিন্তু রাক্ষস অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তেই।
চিৎকার এবং উপর্যুপরি চিৎকারের ফলে পাশের ঘর থেকে মেয়েরা জেগে উঠে দুটি ঘরের মাঝখানের ভেজানো দরজা খুলে দাঁড়াল।
তাদের মা বলল, দেখ, দেখ, তোদের ঠাক্মা আমায় মারতে এসেছিল।
ঊর্মিলা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েও বলল, না না, রাক্ষস…
ছোটো মেয়েটা ভয় পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল।
###
বৃষ্টির দেখা নেই। সারা পৃথিবী রৌদ্রে পুড়ছে। জীবনের ভিতরে অন্তর শুকিয়ে আসছে। সূর্যও নেমে এসেছে নীচের আকাশে। পৃথিবীর অনেক কাছাকাছি এই আকাশ চোখে দেখতে পাচ্ছি আমরাও। তা সত্ত্বেও এই ঘটনার পর কয়েক দিন কেটে গেল। এবং নিমাই বাড়ি ফেরার আগের দিন থেকেই কুকুরটিও উধাও। শুধু ঊর্মিলা তাকিয়ে রইল দক্ষিণ থেকে আসা বাতাসের দিকে— যে বাতাস তাপ উগরে বয়ে চলেছে দিগ্বিদিক।
উত্তাপের আতিশয্য বজায় রেখেই এই বাতাসও যে একসময় থেমে যাবে ঊর্মিলা ভাবেনি। এবং এ-ও ভাবেনি নির্দিষ্ট দিনের দু-দিন আগেই নিমাই বাড়ি চলে আসবে। আর মাঝে মাঝেই মাজার যন্ত্রণা তাকে কাহিল করে দেবে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া বাতাসের দিকে পিঠ করে দাঁড়াল নিমাই—
মা, তুমি নাকি রাক্ষস মেরেছ?
হ্যাঁ। মেরেছি বই কি। তা না মেরে ছেড়ে দেব? বলল ঊর্মিলা। কিছুক্ষণ থেমে বলল, তা তুই জানলি কী করে?
তুমিই তো সারা পাড়া গেয়ে বেড়াচ্ছ! নিমাই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
ঊর্মিলা নিমাই-এর দিকে তাকাল, তারপর নিজের কদর্য পায়ের দিকে। বলল, কিন্তু সে তো বলে, আমি তাকেই মারতে গেসলাম।
নিমাই তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে থাকে।
বলে ঊর্মিলা, সেদিনের পর থেকে সমানে গালাগালি করে যাচ্ছে।
নিমাই বলল, আর করবে না।
ঊর্মিলার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠল—
হ্যাঁ বাবা, বারণ করে দে। খেতে দিচ্ছে না, দিচ্ছে না— সারাদিন খিস্তি করা কি ভালো!
না, বলল নিমাই, তোমার হাতে খুন হয়ে মরা ভালো।
ঊর্মিলা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।
নিমাই বলল, আমি দু-এক দিনের মধ্যে ওদের নিয়ে যাব। তার মধ্যে যেন বঁটির কোপে মেরে ফেল না।
ঊর্মিলা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। দক্ষিণ থেকে আসা বাতাস পিঠ দিয়ে আটকে দিয়েছে ছেলে। দেহ বেয়ে ঘামের ধারা নেমে আসছে। মণ্ডল বাড়ির বাগানে কোনও পাখির ডাক পর্যন্ত নেই।
সে আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিয়ে বলল, থাকবি কোথায়?
নিমাই বলল, ফুটপাথে থাকব তা-ও স্বীকার,— এ বাড়িতে আর না। এখানে হয় তুমি, নয় ওরা।
ঊর্মিলা একবার শেষ চেষ্টা করার ভঙ্গিতে বলল, বিশ্বাস কর খোকা, ওটা রাক্ষস। ও-পাড়ার সৌরভের রূপ ধরে আসত। বিশ্বাস কর… আমি…
নিমাই চলে যেতে যেতে বলল, আমার আর কোনও কথা নেই। যা বললাম মনে রেখ।
ঊর্মিলা নিমাই-এর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
###
সেই মাজার যন্ত্রণা ঊর্মিলার, আবার শুরু হল সেই রাত থেকে। কিন্তু অন্য দিনের মতো কয়েক ঘণ্টা পরে কমে গেল না। ফলে, পরদিন সে ভাত রান্না করতে পারল না। এই বেখাপ্পা গরমে সারা দিন-রাত বিছানায় পড়ে থাকল। কেউ খোঁজ নিল না।
কৌটোতে কিছু নরম হয়ে যাওয়া মুড়ি ছিল— তাই-ই চিবিয়ে চিবিয়ে খেল সে। তামাকপোড়ার পিপাসায় গলা শুকিয়ে এল। সহ্য করতে না পেরে সে মাঝে-মাঝে কাতর গলায় মেয়ে দুটিকে ডাকল। কিন্তু কোনও সাড়া পেল না। কেবল যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে অগভীর তন্দ্রায় দেখল, এবার মরে যাচ্ছে।
তারপর সে মরে গিয়েছিল কি না আমরা জানি না। কিন্তু এটা যদি গল্প হত, তবে যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে হঠাৎ একসময় ঠেলে উঠত ঊর্মিলা। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসত বিছানায়। যন্ত্রণার জায়গায় হাত চেপে ধরত। তারপর তোশকের তলা থেকে লুলিয়ে রাখা টাকা ক-টা বের করত। লাঠিটা শক্ত করে ধরে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করত এবং পারত অবশেষে।
বাইরে বেলা পড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে, দূরের বাঁশঝাঁড়ে একটা তীক্ষ্ণ গলার পাখি ডেকে উঠলে, ঊর্মিলা আস্তে আস্তে বাইরে বেরত। বাড়ির পেছন থেকে সামনে এসে রাস্তায় ওঠার আগে দেখত: নিমাই, বউ আর দুই মেয়ে যত্ন করে পোষা খরগোশ দুটোকে ঘাস খাওয়াচ্ছে। ঊর্মিলার দিকে ওরা তাকাত কিন্তু কোথায় যাচ্ছে কেউ জিজ্ঞেস করত না।
ঊর্মিলা দেখত, রাস্তায় একটা খেঁকি জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে। ভাবত সে, হ্যাঁ, হ্যাঁ—সেই খেঁকিটাই বোধহয়।
আস্ত একটা রাক্ষস মারার পর গলাকাটা ভূতের দেশে ফিরে যেতে এরপর আর কোনও বাধা থাকত না ঊর্মিলার।
লেখক পরিচিতি : সৌরভ চক্রবর্তীর বড়ো হয়ে ওঠা বসিরহাটের গ্রাম পূঁড়ায়। প্রাথমিক শিক্ষার কয়েক বছর কেটেছে নদিয়ার মোহনপুরে, জন্মও সেখানেই ১৯৮২ সালে। এরপর বসিরহাট কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক কিন্তু স্নাতকোত্তর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।তারপর পিতৃবিয়োগ, পেশাজীবনের অনিশ্চয়তা— এসব নিয়েই চলেছে জীবন। ২০০০ সাল থেকে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন নাবিকী পত্রিকা।কথাসাহিত্য রচনার সূত্রপাত সেই সময় থেকে। প্রথম মুদ্রিত গল্প ওই পত্রিকাতেই, এই গল্পের কোনও নাম দেওয়া হয়নি। তারপর নিজস্ব স্বরের সন্ধানে বছর কেটে যেতে যেতে ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রাপ্তি বিষয়ক একটি ঊনকথা এবং আত্মভুক— যা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: “মৎস্যকন্যা আসলে একটি ভ্রম” (অভিযান পাবলিশার্স, কলকাতা/ ২০২০)। জীবন দেখা তাঁকে ছুটিয়ে বেড়ায়, ছুটিয়ে বেড়ায় অন্তর্লীন বিপন্নতার বিষাদ। সেখান থেকেই আখ্যানগুলির যাত্রা শুরু হয় তারপর চলতে থাকে, কিন্তু শেষ হয় না। তাঁর মতে, এই পৌঁছতে না পারাই আসলে ছোটগল্প, আখ্যান আসলে পৌঁছতে চাওয়া এবং না পারারই লিখিত রূপ।