মানুষ- সমাজ

শারীরিক দূরত্ব না সামাজিক দূরত্ব? – তাপস দাস

নরসুন্দা ডটকম   এপ্রিল ১২, ২০২০
শারীরিক
শারীরিক দূরত্ব না সামাজিক দূরত্ব খুঁজতে খুঁজতে তিন সপ্তাহ হতে গেল। এখনো প্রশ্নের উত্তর ঠাহর করতে পারলাম না। ১৯ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। দেশবাসীকে পরামর্শ দিলেন সংকল্প নিতে ও সংযমী হতে। বললেন, দেশের সামনে মহাবিপদ এসেছে যার নাম ‘করোনা (covid 19) ‘। করোনা ভাইরাস বিশ্বজুড়ে মহামারি ঘটাতে চলেছে। বাঁচতে social distancing এর পথে চলতে হবে।

‌‌’পৃথিবীটা না কি ছোট হতে হতে 

স্যাটালাইট আর কেবেলের হাতে

 ড্রয়িং রুমে রাখা  বোকা বাক্সতে বন্দী”

গান শুনতে শুনতে বড় হওয়া আমাদের প্রজন্ম বারবার ভেবে এসেছে সমাজবদ্ধ জীব মানুষ ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ছে। আত্মকেন্দ্রিক একাকি জীবন ডেকে আনছে অবসাদ। তাই প্রয়োজন আরো বেশী করে সমাজবদ্ধ হয়ে ওঠার চেষ্টা করা। শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখতে পারলেই সংক্রমণ আটকানো সম্ভব কিন্তু করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যর ভয়ে আমরা ‘সামাজিক দূরত্ব’ তৈরির তত্বকে বিনা দ্বিধায় মেনে নিলাম। জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এই সমস্য বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক-সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে এনে ফেললো।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে বিশ্ব ভাবছিল , ‘Health For All’ এর প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারবে ২০০০ সালের মধ্যে। কিন্তু তা সম্ভব হল না। আজ পুঁজি নির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় শরীর হল ব্যাবসার কাঁচা মাল। যদিও এইসব নিয়ে গল্প করতে আজ আসিনি,  আজ বসেছি এই লক ডাউনে সমাজ চ্যুত হয়ে ঘরে সময় কাটানোর গল্প ভাগ করে নিতে।

প্রায় মধ্য চল্লিশে, একদশকের বিবাহিত জীবন পার করার পর “গৃহস্থ” হয়ে উঠলাম। গৃহকর্মে নিপুন কোন কালেই ছিলাম না (যদিও কোন কাজেই নিপুন নই) আজও নই। তবে হাত না কেটে মাছ কাটা থেকে শুরু করে এমন অনেক কাজ করছি যা আগে কোন দিন করা হয়নি। ঘরে কোনে অবহেলায় পড়ে থাকা জীবনস্মৃতির অমূল্য সব ধন আবিস্কারসহ মেয়ে উপাসনা (৮ বছর) আর ভাইপো মায়াঙ্ক (৬ বছর) এর সঙ্গে সময় কাটানোর আনন্দ উপভোগ করছি এই সময়। 

পড়তে পারেন…

অবাঙ্মানসগোচর ।। সত্যজিৎ রায় মজুমদার

প্রতীক্ষা : এরশাদুল হক

সঙ্গে কিছু বই নাড়াচাড়াও চলছে। এই সুযোগে আগ্রহী মনকে  ছুঁয়ে চলছে তার কয়েকটি “লাইন”ভাগ করে নেওয়া যাক-
১/ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের, একটি চটি বই ‘প্রাচীন ভারতে চিকিৎসা বিজ্ঞান ‘ (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমী ) থেকে,  “আপাতত- অত্যাশ্চর্য বলে মনে হলেও ভারতীয় সংস্কৃতির একটা বৈশিষ্ট হল,  চিকিৎসা-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে দেশের আইনকারদের তীব্র বিদ্বেষ। বিদ্বেষটা এতদূর গড়িয়েছিল যে শাস্ত্রকারদের ঘোষণা অনুসারে এই বিজ্ঞান নিয়ে উৎসাহের ফলে মর্তের মানুষ তো ছোট কথা, এমনকি  খোদ দেবতাদেরও জাতে মারা পড়েন। এবং তাঁদের জন্যে শাস্ত্র-বিহিত প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিতে হয়।(পৃষ্ঠা -২৫)
তিনি আরো বলছেন, ধর্ম শাস্ত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিদ্বেষ বুঝতে যজুর্বেদে ফিরে যেতে,
তস্মাৎ ব্রাহ্মণেন ভেষজং নকার্যমম্
অপূতঃ হি এষঃ অমেধ্যঃ যঃ ভাষা।।
              (তৈত্তিরীষ সংহিতা ৬/৪/৯)
আজ যখন দেশের কোন কোন স্থান থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে সাধারণ নাগরিকরা চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীদের প্রতি দূর্ব্যবহার করছেন বা সরকারের তরফে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ছাড়া তাঁদের করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে বাধ্য করছেন, তখন আমরা তার প্রতিবাদ না করে খানিক ধৈর্য্য রাখতেই পারি এই বলে,  বহুদিনের শাসকের অভ্যাস এত সহজে কি বদল হয়?  চরক সংহিতা সম্পর্কে আলোচনায় চিকিৎসা-বিজ্ঞানের চারটি বিষয় উল্লেখ করছেন, তা হল চিকিৎক, দ্রব্য (ওষুধ, ইত্যাদি ) শূশ্রুষাকারী এবং রোগী।
শূশ্রুষাকারীর চারটি অভিপ্রেত গুনঃ
উপচারজ্ঞতা দক্ষাম অনুরাগঃ চ ভর্তরি। 
শৌচং চইতি চতুষ্ক অয়ং গুনঃ পরিচরে জনে।। 
                                                   ১/৯/৮
অর্থাৎ : ১) শুশ্রূষা-কৌশলের জ্ঞান
            ২) দক্ষতা
            ৩) রোগীর প্রতি অনুরাগ
            ৪) শুচিতা। 
প্রতিটি বিষয় আজও সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। 
রোগীর চারটি অভিপ্রেত গুন:
স্মৃতিঃ নির্দেশ-কারিতত্বম অভিরুত্বম অথ অপিচ। 
জ্ঞাপকত্বং চ রোগানাম আতুরস্য গুনাহ স্মৃতিঃ।। 
                                                          (১/৯/৯)
 অর্থাৎ : ১) স্মৃতি শক্তি 
              ২) চিকিৎসকের নির্দেশ পালন
              ৩) মনোবল বা সাহস
              ৪) রোগ সংক্রান্ত তথ্য জ্ঞাপন।। 
                                          (পৃষ্ঠা : ৪১-৪২)
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই, স্বভাব বসত বাঙালি পুরুষ ‘পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক হন’ এই আটকে থাকা জীবনে তাঁদের এই গুণ প্রমাণিত করার মস্ত সুযোগ। আমার ধারণা তাঁরা তা করছেন। তাই দেশ জুড়ে মহিলা কমিশনের কাছে পারিবারিক নির্যাতনের যে অভিযোগ জমা পড়েছে সেই তালিকায় বাঙালিদের অবস্থান নীচের দিকে, উত্তর প্রদেশ সবার উপরে।যদিও অনলাইন মারফত জমা পড়া এই তালিকা ভারতের চিত্র বোঝাতে পারবে না। স্ত্রী কে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করতে পারদর্শী ‘টাটা কম্পানি’র মস্ত অফিসারের গুণকীর্তন শুনতে গত মাসে চেন্নাই হাইকোর্ট পৌঁছাতে হয়েছিল। মহিলাদের শাসনে ভারতীয়রা বহু যুগ ধরেই পারদর্শী, ঐতিহ্যশালী সেই সবের কিছু উদাহরণ নেওয়া যাক অশোক রুদ্র লেখা, “ব্রাহ্মণ্য ভাবধারা ও আধুনিক হিন্দু মন” (পিপলস বুক সোসাইটি) বই থেকে।

“মহর্ষিঅষ্টাবক্রের নিম্নলিখিত উক্তিটি খুবই সুপ্রসিদ্ধ ও সুবিদিত : ত্রিলোক মধ্যে কোন স্ত্রীর স্বাধীনতা নেই। দেখ, কুমারাবস্থায় পিতা, যৌবনাবস্থায় ভর্ত্তা ও বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রেরা স্ত্রী জাতীর রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকে, সুতরাং স্ত্রী জাতীর কখনও স্বাধীনতা থাকিবার সম্ভাবনা নাই। (পৃষ্ঠা : ৮৬, মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, অধ্যায় ২০) ঐ বই থেকে,

রাম ভরতকে বলছেন, ভরত কর্তৃক প্রাথিত হইলে আমি নিজেই রাজ্য স্ত্রী প্রিয়জীবন এবং ধন সকলই ভরতকে প্রদান করিতে পারি। দেখা যাচ্ছে আদর্শ পতি শ্রী রাম চন্দ্র তাঁর পত্নী সীতাকে ভরতকে দিয়ে দিতে রাজি ছিলেন, ঠিক যেমন ভালবাসার পরাকাষ্ঠা হিসাবে কেউ তার প্রিয়তম বস্তুকে দান করে দিতে পারে। “(পৃষ্ঠা :৮৬,রামায়ণ, অযোধ্যাকান্ড,সর্গ: ১৬) দূরদর্শনে চলা কোন সিরিয়ালে এই বক্তব্য কে সমর্থন না করলে তার দায়িত্ব আমার নয় উল্লেখ করা বইয়ের লেখকের।
ঘরবন্দি এই সময়ে অধার্মিক -নাস্তিকতা চর্চার মাঝে বিজ্ঞান সংগঠনের উদ্যোগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করা, অঞ্চলের প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে পাশে থাকিস রক্ত দানের মতন অল্প কিছু সমাজবদ্ধ জীব হওয়ার দায়িত্ব পালন করছি। এই ঢোলটাও একটু পিটিয়ে রাখলাম এই সুযোগে।
আরও পড়তে পারেন….
সনাতন ধর্মের স্বর্ণ যুগের জাবর কাটার মধ্যে অন্য কিছু বইও নাড়াচাড়া চলছে, যেমন নিরঞ্জন হালদারের সম্পাদনায়, “ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মুসলিম শহীদ”(সুশিক্ষা) থেকে একটি প্রশ্ন তুলে রাখি : ভারতে তুর্কী সম্রাটদের প্রথম আক্রমণ ১০০১ সাল থেকে ভারতে মুসলিম আগমন। সেই পশ্চিমী সম্রাটদের লুঠ থেকে শুরু করে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার চলে।” ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় হিন্দু-মুসলমান সকলে যে বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট হিসাবে মেনে নিয়েছিল, তার কারণ আকবর থেকে শাহজাহান পর্যন্ত মুঘল সম্রাটদের উদার মানসিকতা।” (পৃষ্ঠা :২১)
স্বাধীনতা আন্দোলনে সাধারণ কর্মী হিসেবে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতাউত্তর সমাজতন্ত্রী দলে যুক্ত হওয়া বিশিষ্ট সাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ীর “ঢোঁড়াই চরিত মানস” উপন্যাসে ভারতবাসীর মনে যে ভাবে “রাম” বিরাজ করছেন তার ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন তা এক কথায় অনবদ্য। ভারতবাসীর মনে রামলালার অস্তিত্ব-বাস্তবতা স্বীকার করেই ভারতে শ্রেনী সংগ্রাম বা জাতি ভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা ভাবা দরকার বলে আমার মনে হচ্ছিল উপন্যাসটি পড়ার সময়। দেশজুড়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের দূর্বল হয়ে পরা দেখে মনে প্রশ্ন হচ্ছে, বিগত একশো বছরে বামপন্থী দলগুলিতে ধারাবাহিক আত্মত্যাগী-একনিষ্ঠ-উচ্চ মেধা সম্পন্ন কর্মী নেতৃত্ব যুক্ত হয়েছেন তা হয়তো অন্য কোন রাজনৈতিক দল পায়নি, তবুও বামপন্থার চর্চার পরিধি কোন দিনই বাড়তে পারেনি সেই অনুপাতে।

আজকের আড্ডা-গল্প শেষ করবো আর কয়েকটি লাইন লিখে, “কল আসিয়া যেমন তাঁতকে মারিয়াছেন তেমনি ব্রিটিশ শাসনও সর্বগ্রহ ও সর্বব্যাপী হইয়া আমাদের গ্রাম্য সমাজের সহজ ব্যবস্থাকে নষ্ট করিয়া দিয়াছে”

 “ব্রিটিশ ব্যবস্থা যত বড়োই হউক

   তাহা আমাদের নহে।”

সভাপতির অভিভাষণ, পল্লী প্রকৃতি বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে এই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পল্লি পুনর্গঠন উদ্যোগের চেষ্টাতে টিকে থাকার মন্ত্র লুকিয়ে আছে আমার মনে হয়। আত্মশাসিত-বিজ্ঞান মনষ্ক সমাজ মানুষ জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পরবে নতুবা এমনি একের পর এক বিপর্যয় কেয়ামতের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলবে।। 
       নটে গাছটি মুড়োল
       আমার কথাটি ফুড়োল।
লেখক : নদীকর্মী, কলকাতা, ভারত।

About the author

নরসুন্দা ডটকম