ঈদ সংখ্যা ২০২০

শাড়ি ।।  আমিনুল ইসলাম সেলিম

নরসুন্দা ডটকম   মে ১৮, ২০২০
শাড়ি

আচমকা হৈ হৈ করে ছুটে এলো বউ। যেনো বিরাট কিছু ঘটতে চলেছে অথবা এমন কিছুর সন্ধান পাওয়া গেছে, যা বহদিন ধরে খোঁজা হচ্ছিলো। বউয়ের চোখে মুখে ঝলমলে রোদের মতো আনন্দের ঝিলিক। শরীরজুড়ে আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গি নিয়ে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।

ঠোঁটের আরাম নষ্ট না করে শরীরী ভঙ্গিতেই জানতে চাইলাম, কী হলো, এতো আনন্দ কেনো? প্রশ্ন শুনে যেনো সে আশ্চর্য হলো আমার চেয়েও। যেনো, এমন করে কেনো সে ছুটে এসেছে, এর কারণ আমার জানা থাকারই কথা। তরুণী বেদেনীর মতো সে হাত আর সারা শরীর নাচিয়ে মুখ ভেংচালো, জান না বুঝি! আজ না দশ তারিখ? চল চল, শাড়ি কিনতে হবে আমার! বলেই সে সাজতে চলে গেলো।

পুনরায় বইয়ের ভেতর ডুবে যাওয়ার আগে মনে পড়লো, হ্যাঁ, তাই তো! সরকার তো বলেছে সীমিত আকারে ১০ তারিখ থেকে শপিংমল খোলা থাকবে। এবার আমার কড়কড়ে টাকাগুলো তাসের মতো উড়তে থাকবে। টাকা উড়তে থাকা নিয়ে দুশ্চিন্তার চেয়ে বড়ো কথা হলো, গোপন শত্রুর মতো আমার ঘরে করোনা এসে অতিথি বা আততায়ী হয় কি না। বউকে এ কথা বোঝানোর চেয়ে ভালো হবে নিজের কান ধরে জোরে দুটো টান মারা। বউ আমার গাড়ল ধর্মজীবীদের মতোই ত্যাড়া। সামান্য করোনার পরোয়া টরোয়া সে করে না।

প্রথমে বউ ভাবলো, স্যালোয়ার-কামিজ পরবে। শপিংয়ের ক্ষেত্রে স্যালোয়ার-কামিজ বেশ আরামদায়ক। তাও আবার ভীড়-বাট্টার ব্যাপার। তাও ঈদের শপিং। সে একটার পর একটা স্যালোয়ার-কামিজ আলনা থেকে নামাচ্ছে আর উল্টাচ্ছে আর খাটের কোণায় ভাঁজ করে রাখছে। দু তিনটা গায়ের উপর জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছেও সে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আর গুণগুণ করে গান গাইছে। বউয়ের গুণগুনে গলা অবশ্য মন্দ না। শুনে হাসি চেপে রাখা কষ্টকর বলে মাঝেমাঝে আমার কাশি চলে আসে। আমি কাশি দিয়ে হাসি ঢাকার গোপন চেষ্টায় রত হই।

বউ প্রত্যেকবার আয়নার সামনে যাচ্ছে আর আধাঘন্টা করে সময় চলে যাচ্ছে। যেনো দ্রুতগামি পাখির মতো উড়ে যাচ্ছে সময়। একে একে সাতাশটি ঘাটা শেষ হলে ‘বিরাট ভুল করে ফেলেছি’ এমন ভাব করে সে নিজের জিহ্বা বের করে কামড় দেয়। আমি হাসতে পারি না, খুব আস্তে করে কাশি দেই। যেমন করে লোকেরা চেপে চেপে পায়ুপথের বায়ু আটকানোর চেষ্টা করে। হঠাৎ মনে হলো, আমার প্রস্তুতির কাজটাও সেরে ফেলি। কখন আবার গোঁয়ার মেঘের মতো গর্জে ওঠে কে জানে! ব্রাশ দিয়ে জুতোজোড়া মুছি, নিপুণ মুছির মতো। ফিতা দুটো খুলে ফেলি। তারপর সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে হাতে নিয়ে বসে থাকি।

বউ ওয়ারড্রোব খুললো। তার মনে হলো, বাঙালির এমন একটা উৎসবের মাসে স্যালোয়ার-কামিজের কথা সে ভাবলো কী করে! এটা অন্যায়। বাঙালিত্বের স্পষ্ট অপমান। যেমনই হোক, তার তো অন্তত ১১টা শাড়ি রয়েছে। শাড়ির কথা মনে হতেই কষ্টে চোখে পানি চলে আসলো। আর মাত্র তিনটা শাড়ি হলেই জয়িতা ভাবিকে টপকাতে পারতো সে। জয়িতা ভাবি ১৩টা শাড়ির ছবি ফেসবুকে দিয়েছিলো। সে ১১টা। ইশ! অল্পের জন্য জয়িতা ভাবির থোতা মুখ ভোতা করতে ব্যর্থ হওয়াটা বুকের ভেতর যেনো রেডমার্ক হয়ে আছে।

ফেসবুকে শাড়ি প্রদর্শনীর ব্যাপারটা বলা যায় মাটিই হয়েছে বউয়ের। জয়িতা পালের স্বামী সরকারি চাকুরে। ডানহাত, বাঁহাত, উপরিহাত- তিন হাতে টাকা কামায় লোকটা। স্বামীকে নিয়ে কী বড়াই! মহিলার দেমাক দেখলে পিত্তি জ্বলে নুন হয়ে যায় আমার বউয়ের। সে এবার তাই আরও ৬টা শাড়ি কিনবে। যাতে, জয়িতা দুটো বা তিনটা শাড়ি কিনলেও আর কমতি না হয়। আমার মাথায়ও হাত, পাছায়ও হাত। কতো টাকা খরচ হতে পারে আন্দাজ করি আর ফিতা কামড়াই।

বউ নিজের শাড়ি বের করে। গতবারের কেনা বৈশাখী শাড়িটা পরবে কি না, পাশের রুম থেকে জোর গলায় ক্যাচরম্যাচর করে। আমিও চেঁচিয়ে জানাই, লকডাউন চলছে তো, এই শাড়িটা আমাকে দাও, আর তুমি বরং বিয়ের শাড়িটা পরে নাও। পুরনো ইঞ্জিনের মতো গড়গড় করতে করতে সে থেমে যায়। আমি কাশি আর ফিতা কামড়াই। শেষ পর্যন্ত একটা শাড়ি তার পড়ার মতো মনে হলো, যেটা আমার এক বন্ধু বিশেষ দিনে গিফট করেছিলো।

সে শাড়ি পরলো, তারপর মেকাপ শুরু করতে করতে বললো, কই, তুমি রেডি হইছো? আমি রজমিস্ত্রির যোগালির মতো হাঁক দিয়ে বলি, হ হ, রেডি আছি। সময় বেশি লাগে বলে বউ সাধারণত মেকাপ করে না। শাড়িও তেমন পরে না, কারণ ওই একটাই- সময় বেশি লাগে যে! আজকের মতো কম সময় লাগবে জানলে সে সবসময় শাড়িই পরতো। মাত্র দেড়ঘন্টায় তিনটি শাড়ি পাল্টে এই চতুর্থ শাড়িটা পরে ফেলেছে সে। নিজের তড়িৎকর্মে নিজেই সে আশ্চর্য না হয়ে পারে না। মেকাপটাও আজ কম সময়েই করতে চায় সে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তাতে কী! মার্কেট তো আটটা পর্যন্ত খোলা। আমি তাগিদ দেই না। আমার কাশি আসে আর আমি জুতোর ফিতা কামড়াই। জুতোর ফিতা কামড়ানো অবশ্য আমার দোষ না। স্টুডেন্টলাইফ থেকেই আমার অভ্যাস এটা। দুশ্চিন্তায় পড়লেই আমার জুতোর ফিতা কামড়াতে ইচ্ছে করে।

একবার উঁকি মেরে দেখলাম, বউ লাল লিপস্টিক পরেছে। লাল লিপস্টিকপরা ঠোঁটের প্রতি আমার আলাদা আকর্ষণ আছে। একবার ভাবলাম, বউকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। আবার মনে হলো, নাহ! লিপস্টিকপরা ঠোঁট নিয়ে যদি তেড়ে আসে আবার! গলায় চেন, কানে দুল, হাতে চুড়ি, আঙুলে আংটি আর পায়ে মল পরা ছাড়া বাকী কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে বউ। নিজের জায়গায় ফিরে এসে আমি আবার ধ্যানীর মতো স্থির হয়ে বসি।

কাশি আসে, কাশি দেই আর পুরনো অভ্যাসবসত জুতোর ফিতা কামড়াই। সময় যেনো দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, ত্রাণের চালের মতো, টিসিবির তেলের মতো। হঠাৎ বউয়ের তাড়া, এ্যাই তারেক, চল চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, আমরা ঘন্টা তিনেক সময় পাবো তো! আমি হাতঘড়িতে তাকাই। তাকিয়ে করোনারোগির মতো ভয়ার্ত হয়ে উঠি। দেখি আটটা বাজে এবং আরও দেখি, কামড়াতে কামড়াতে জুতোর দুটো ফিতাই আমি খেয়ে ফেলেছি।

আমিনুল ইসলাম সেলিম : কবি ও গল্পকার।

আরও পড়ুন…
কবিতা ।। দীপক মান্না
অতনু রায় এর কবিতা
লাল পাসপোর্ট ।। গাজী মহিবুর রহমান
অস্তরাগ ।। সৈয়দ কামরুল হাসান

About the author

নরসুন্দা ডটকম