ঈদ সংখ্যা ২০২০

স্বপ্নের জানাজা ।। দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

নরসুন্দা ডটকম   মে ১৯, ২০২০
জানাজা

রাত সাড়ে বারোটা। লিখতে বসেছি। না আজ নেশা করিনি। নেশা করিনি কারণ নেশা করে আমি ক্লান্ত। শরীর জুড়ে ব্যথা, মাথা ভার, অবসন্ন, অবসাদগ্রস্ত মনও। সারাদিনটা কাজে কর্মে — নেশা করা বা নেশা না করার কথা ভাবার সময় থাকে না।

তবু সব কাজের শেষে যখন একা হয়ে যাই, নিজের সামনে আমি ছাড়া আর থাকে না কেউ তখন ঐ নেশা করার ভূতটা এসে হাজির হয়। কেন না আমি জানি পানীয় ছাড়া  জাগ্রত রাত — চোখ বন্ধ করে শুয়ে ভেড়া গোনা। শুরু করলে ঘুম আসে না — আসে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দৃশ্য। কিন্তু আমি তো ঘুমোইনি, এই অবস্থায় দেখা দৃশ্যগুলোকে কি স্বপ্ন দৃশ্য আখ্যা দেওয়া যায়? অস্পষ্ট সব কাহিনি রেখা আমি সজ্ঞানে তৈরি করছি এবং ভাঙছি — আর এই ভাবেই কোন একসময় ভোর হচ্ছে — ক্লান্তি ধেয়ে আসে শরীরে মনে। আমি জল খাচ্ছি, পেচ্ছাপ করছি — আর তারপর কোন একসময় ড্রয়ারে খুঁজে নিচ্ছি ভেলিয়াম ফাইভ, ভোরের আলোয় অর্ধ জগরণে জানালা বন্ধ করে দেহটাকে ছুঁড়ে দিচ্ছি বিছানায়

অতঃপর স্বপ্নহীন কয়েকটা ঘন্টা — আর সকাল হতেই তীব্রভাবে বেজে উঠছে মোবাইলে অ্যালার্ম। আমার আমি তখন তীব্রভাবে হাতড়ে বেড়াচ্ছে এ্যালার্ম বন্ধের বোতাম, পাচ্ছে না, কারণ কেজো লোকটা জানতো এই রকম কিছু ঘটবে তাই সে মোবাইলটা রেখেছে টেবিলের ওপর — বিছানা থেকে তার দূরত্ব অনেকটাই। আর কেজো লোকটা জানে একবার যদি বিছানা থেকে আমি উঠে পড়ি তখন আর শুতে পারবো না। কেন না সকালের আলো এবং ঘড়ির কাঁটা আমাকে পরিণত করে দেবে একটা কেজো মানুষে। যে মানুষটা ঘুম থেকে উঠেই বাথরুমে যাবে। সেখানের কর্মটি সেরে, দাঁত মেজে, স্নান করে সোজা  ব্রেকফাস্টে। আর চায়ের সাথে ভেবে নেবে সারাদিনের ক্রিয়াকর্মের যাবতীয় ও পরিকল্পনা।

            কিন্তু নেশাহীন রাত তো ব্যতিক্রমী ঘটনা। দশটার সময় রাতের খাবারের সাথেই পেগ বানিয়ে ও বসে যায়। খাবার শেষ হয়, পেগ চলতে থাকে। মন গল্প তৈরি করে, গল্প ভাঙে। সেই সব গল্প খাতায় বা কম্পিউটারে উঠে আসে না — যেন ঐ সব বিলাসিতার মুহূর্তগুলো সে উপভোগ করে। চরিত্রগুলোকে ইচ্ছে মতো ডানা মেলতে দেয়, কাহিনিকেও — ঘটনাক্রম সাজাতে সাজাতে উপাখ্যানের আকার নেয় আর তারপরই দু’চোখে নেমে আসে ঘুম। সে কোনোক্রমে আলো নেভায় এবং শুয়ে পড়ে। স্বপ্নহীন কয়েকটা ঘন্টা মৃত মানুষের মতো পড়ে থাকে তার দেহ। এবং নিদ্রাভঙ্গে যথারীতি ঐ কেজো মানুষটার আবির্ভাব ঘটে। আর এক কালের গল্পকার মানুষটার আফশোস ঝরে পড়ে, না কালকেও লেখা হল না গল্পটা!

            ওর একটা ব্যবসা আছে এবং ব্যবসাটা যথেষ্ট বড়। গোটা সাতেক কম্পিউটার, ডিজিটাল ফোর কালার মেশিন, ফ্লেক্স মেশিন, অফসেট মেশিন, বাইন্ডিং মেশিন আরো অনেক কিছু নিয়েই তার ডিজিটাল প্রিন্টার্স। সাত-দশজন কর্মী থাকা সত্তে¡ও সে মেন কম্পিউটার, কাস্টমার ডিলিংস সে কমীদের হাতে ছাড়ে না, কেননা সে ঘর পোড়া গরু, জানে বিশ্বাস শব্দটা চূড়ান্ত পর্যায়ের আপেক্ষিক শব্দ, শুনতে যতটা ভালো প্রয়োগে ততটাই দুর্বল এবং বিপজ্জনক। তাই সবটাই সে রাখে তার নিয়ন্ত্রণে।

             ও মেল খুলে অর্ডার চেক করে। দেখে রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জীর পক্ষে অনেকগুলো ফ্লেক্স-এর ডিজাইন পাঠিয়েছে বিজেপির লোকাল নেতা। ঠিক তারপরেই জগদীশের মেল, শাসক দলের ব্লক সভাপতি, ও পাঠিয়েছে রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জীর বিপক্ষে কতগুলো ম্যাটার। হাসি পেয়ে যায়, কিন্তু সে হাসে না, বরং অর্ডারের অর্থমূল্য নির্ধারণ করে। গতবারের দশহাজার টাকা এখনও বাকি — ফোন করে সেটা জানাতে দ্বিধা করে না। এই শহরের প্রাচীন বাসিন্দা তাদের পরিবার — কিছু হক তারও আছে, অতএব ফুল পেডের প্রতিশ্রুতি পেয়ে কাজগুলো ফরোয়ার্ড করে সে। এভাবেই প্রতিদিন শুরু হয় তার কর্মচঞ্চল দিনযাপন।

            ফলত আমরা হারাই একজন ভালো গল্পকারকে। অথচ ও জীবনকে মুক্ত করতে চেয়েছিল। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে ওর বউ পালিয়ে যাওয়ার পরে ও আর বিয়ে করেনি। মেয়েটা নাকি কোনো মুসলিম ছেলের সাথে প্রেম করত, বাড়ির লোক জোর করে ওর সাথে বিয়ে দিয়েছিল। আমাদের ধারণা ও নিজেই বউকে পালাতে সাহায্য করে নইলে থানায় ডায়েরি করবে না কেন? সেই থেকেই ওতো মুক্ত বিহঙ্গ।  তারপরই ও ব্যবসায় এতটাই মনোনিবেশ করে যে আমরা হারাই প্রিয় গল্পকারকে। এত টাকা কী করবি, কে খাবে তোর টাকা? ও হাসে, বলে টাকা নয়, আসলে কাজ করাটা এক ধরনের নেশা। আর মুদ্রণ ব্যবসায় দায়বদ্ধতা এতটাই বেশি যে তুই ইচ্ছেমতো ছুটিও নিতে পারবি না। সারাদিন ওই ব্যস্ততার পর গল্প আর আসে না। যদিও আসে ওই সুখ মুহূর্তে মনকে থামিয়ে লিখে ফেলতে ইচ্ছে করে না। বরং মনের মধ্যে লালন পালন করতে বেশ লাগে।

            এবারে আমি নাছাড়, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের গল্পতো ওর জীবনেই আছে। বলাতে বলে, অতীত বড়ই ধূসর, তবে গল্পকারের সব লেখাতেই তো গল্পকার নিজে থাকে — তা সে যাকে নিয়েই লিখুক। আচ্ছা তোর স্বপ্ন সংখ্যায় আমি লিখব, মানে আপ্রাণ চেষ্টা করব।

            রাত্রি দশটা, ওর বিশাল বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে, কাজের লোকটা টেবিলে খাবার দিয়ে যায়, আমার জন্যও। খাদ্যরসিক সে, দু’জন কুক ওর রান্নাঘরে। ও নিজেও রান্না করতে ভালো বাসে। পেগ বানায়, কিমার প্লেটটাকে টেনে নেয়। বলে, চল শুরু করি।ওর জীবনযাপন আমার জানা। বলি, আমি কিন্তু দুটো। বলে, শুরু তো কর। খাওয়া-দাওয়ার মাঝে ওর ফোন আসে। আননোন নম্বর দেখে খানিক দ্বিধা, তারপর ফোনটা ধরে। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে মিটিমিটি হাসে। বলি, কী হল? হাসছিস কেন!

            — তোর গল্পের চরিত্রের ফোন ছিল। রাজ, রাজকুমার সিংহ। সিংহ পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসিকা, কোঁচকানো একমাথা চুল। দর্শনে সত্যিকারের রাজপুত্র যেন।

            — এমন রাজকুমার স্বপ্নের গল্পে প্রবেশ করবে কী করে?

            — তুই আজ আমার বাড়িতে থেকে যা, নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করবি। তুই ঘরে ফোন করে বলে দে।

            — না রে এগারোটা পর্যন্ত থাকতে পারি, কিন্তু তারপরে আমাকে ফিরতে হবেই। কাল সকালে কলকাতা যাবো। তোর এই চরিত্র কখন আসছে?

            অনিরুদ্ধ ঘড়ি দেখে বলে, এখন বলল তো শক্তিগড়ে?

            আঁতকে উঠে বলি, নারে ওর আসতে বারোটা একটা হয়ে যাবে, অত রাত করা যাবে না!

            — ও  আসছে কিন্তু আরব দেশ থেকে। ওখান থেকে এসেছিল মুম্বাই। কিছুক্ষণ আগে নেমেছে দমদম এয়ারপোর্টে। এতরাতে বাড়ির লোককে ডিস্টার্ব করতে চাইছে না তাই আমাকে ফোন। শালা জানে কাল রবিবার। প্রেস বন্ধ। তাই আমাকে জ্বালালে ক্ষতি নেই।

            — আরবে কী করে?

            — বিশ্বাস করবি না!

            — কেন?

            — তবলা বাজায়…

            — তবলা!

            — রাজের স্বপ্ন ছিল জাকির হোসেনের মত ও হবে সেরা তবলিয়াদের একজন। বলছিলাম না তোর স্বপ্ন সংখ্যার গল্পের জন্য ওই আদর্শ চরিত্র। এই আসানসোল শহরটার মতোই ওর স্বপ্নগুলো একদিন মরে গেল। চেয়েছিল তবলা লহরা বাজাতে, এ শহর ওকে জুড়ে দিল বাইজির সাথে। সীতারামপুরের বাইজিদের কাছে ওর তখন খুব কদর। বাইরে কলশো পেলেই ডাক পড়তো ওর। সীতারামপুরে বাজাতে ও রাজি ছিল না, পরিচিত বহু ভদ্রজনের ওখানে যাতায়াত। উভয়েই লজ্জায় পড়বে, তাই ও শুধু বাইরে বাজাত। টাকারও তো প্রয়োজন। হুট করে কমবয়সি একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে তখন। তবলা শিখিয়ে আর কতই বা আয়। বাইজিদের ডাকের অর্থমূল্য অনেক, তার সাথে টিপস। তাছাড়া তবলাটা ও ভালোই বাজায়, ঐ ভয়ানক বেসুরো গজলকে ঢাকতে ওর তবলাই তো ভরসা।

            — আরবে গেল কী করে?

            — মুম্বাই থেকে। ঘটনাচক্র একেই বলে। সীতারামপুরের এক বাইজি ছিল রাজের অন্ধ ভক্ত। সে এক নামী বাইজিকে রাজের কথা বলে রেখেছিল, প্রয়োজনে ডাক দিতে। সেই তার ডাকেই রাজ গেল মুম্বাই। সেখানে আরবের বাইজিও এসেছিল, তার তবলিয়ার শরীর খারাপ থাকায় রাজের আবার সুযোগ এবং সেই মহিলার সাথেই আরব যাত্রা। গত পাঁচবছর ওখানেই স্থায়ী।

            — ওর পরিবার জানে যে বাইজিকে সঙ্গত করে ও?

            — না ওরা জানে এক বিখ্যাত গায়িকার সঙ্গতকার। একথা মিথ্যেও নয়। রাজ ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল আমাকে। যথেষ্ট সুগায়িকা মহিলা এবং সুন্দরীও। আজ ওই মহিলা এসেছে মুম্বাইয়ের এক বিয়ে বাড়ি উপলক্ষ্যে। মাঝে তিন দিনের গ্যাপ। তাই রাজের এই ঝটিকা সফর।

            — ব্যস এই, চমক আছে মানছি, কিন্তু চমক হয়তো নাটকীয়তার আমদানি করতে পারে কিন্তু…

            — রসো বন্ধু রসো, আরো আছে, আরো আছে…

            অনিরুদ্ধের চোখে মুখে রহস্য, বুঝতে পারি গল্পের মুডে আছে। কিন্তু কাল সকালে আমায় আসানসোল এক্সপ্রেস ধরতে হবে। বলি, থাক রে পরে শুনবো। তারচেয়ে বরং কাল ছুটির দিনটা কাজে লাগিয়ে গল্পটা লিখে ফেল। আমি আজ উঠি। বলে রাজের গল্পটা মাঝপথে ফেলে উঠে আসি। ওটা অনিরুদ্ধের গল্প, ওই বরং লিখুক।

                  গাড়িটাকে সীতারামপুর নিয়ে যাবার ইচ্ছে হচ্ছিল। অনেকদিন রজনীর সাথে দেখা হয়নি। এসময়টা ওদের ধান্দার সময় বিরক্ত করা ঠিক হবে না ভেবেই নিজেকে সামলে নিই। কিন্তু কেন জানি না এ শহরে ঢোকার আগে আমার মনটা শ্মশানে যেতে চাইল। শ্মশান দর্শন করেই না হয় অনিরুদ্ধর বাড়ি যাবো। জানি ও প্রতিক্ষায় আছে, থাকুক আরো দশ মিনিট প্রতিক্ষায়। এ শহরে একমাত্র অনিরুদ্ধই তো আমাকে কিছুটা বোঝে। শহরের মূল প্রবেশ দ্বারের পাশ দিয়ে ড্রাইভারকে  ঢুকতে বলি শ্মশান যাওয়ার রাস্তায়। ও ব্যাটা এ রাস্তায় নতুন বুঝতে পারে না বাড়তি পথ নিয়ে চলেছি। যদিও ওর তাতে কিছু যাওয়া আসার কথা নয়। কিলোমিটার হিসেবে চুক্তি। গাড়িটা শ্মশানের ভেতরে নিয়ে যাই না, বাইরে দাঁড় করিয়ে হেঁটে ভেতরে যাই।

            আমার চেনা শ্মশান সম্পূর্ণ অচেনা। অনেক আলো। ইলেকট্রিক চুল্লি। যেন কোনো পার্ক। অচেনা কারো মৃতদেহ। মুখার্জিদার ছেলে সৎকারে ক্রিয়াকর্মে ব্যস্ত। উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে ছেলে। এককালে নির্জন এই শ্মশানে মুখার্জিদা এসেছিলেন তন্ত্রসাধনা করতে। ক্রমে দাহকর্মের সহযোগী, শ্মশানের দ্বারপাল। ব্যাটা তো এখন কপোরেশনের কর্মী।

            অচেনা পরিবেশ, অশ্বত্থ গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে তবু চোখ বন্ধ করতেই পুরোনো শ্মশান, মৃতদেহদের মিছিল, শ্মশানকালীর পুজোয় জীবনের প্রথম মদ্যপান, পাতপেড়ে খিচুড়ি ভোগ গ্রহণ — স্মৃতিরা ভিড় করে এসে চোখ ভিজিয়ে চলে যায়।

             চোখ খুলতেই দেখি কয়েকজন অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। পাগল বা মাতাল কিছু একটা ভাবছে নিশ্চয়। যেমন ফটিকদা এখানে আসত কালীপুজোর রাতে তাঁর প্রিয় ভাইএর আত্মাকে প্রিয় ব্যান্ডের মদ পান করাতে। আমরা বলতাম, কী পাগলামি করছো। ফটিকদা একগাল হেসে বলত, এক ছোট্ট ছেলে, বয়স তিরিশ পেরোতে না পেরোতেই শুধু মদ খেয়েই মরে গেল, ওটা পাগলামি না, তাও কালী পুজোর দিন। আমি তো এই একদিনই পাগলামি করি। ভাইটাকে মনে করি। নেশাটা আমিই ধরিয়ে ছিলাম কিনা! তাও দেখ কখন, না যখন ওই পাজি মেয়েটা ওকে ছেড়ে চলে গেল তখন। দাদা হয়ে আমার উচিত ছিল ওকে অন্য পথ দেখানো তা না…, নিজে যে নেশার মায়া জালে আটকে, সেই জালে ওকেও আটকে দিলাম…

            না স্মৃতি বড় বিপথগামী। ড্রাইভারটা অপেক্ষা করছে। কালীমন্দিরটায় প্রণাম করতে গিয়ে দেখি ঝাঁকড়া এলোমেলো চুলের একজন বসে মন্দিরের বাইরে। মায়ের মন্দিরের কোলাপসেলের গেট বন্ধ, সেই বন্ধ গেট ধরে বসে আছে। দাঁড়িগোঁফের ফাঁকে মুখটা আকাশের মতো। কিন্তু তা কী করে হবে, ও তো কবেই মরেই ভূত হয়ে গেছে। মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা। নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়ির স্বাধীনতায় স্বামী-স্ত্রী উদ্দাম জীবন যাপন। অদৃশ্য ত্রিকোণ না চতুষ্কোণ প্রেম, তারপর সেই ভয়ানক সকাল, ফ্যান থেকে ঝুলন্ত ওর ঘ্মুন্ত দেহ…। না শরীর টাকে জোর করেই শ্মশানের বাইরে নিয়ে আসি।

            গাড়িতে বসতে না বসতেই অনিরুদ্ধর ফোন। বলি, চলে এসেছি। ওকে শ্মশানের কথা বলি না। বরং গিয়ে বলা যাবে। গাড়িটাকে দোমোহানি রেলওয়ে কলোনির রাস্তায় গিয়ে ফেলতে বলি। এদিক দিয়েই শর্টকাট হবে।

            অনিরুদ্ধর বাড়িটা আমরা মরূদ্যান বলতাম। ওই পেল্লায় বাড়ি সম্পূর্ণ গাছপালায় ঢাকা। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতরে ওই রকম একটা বাড়ি থাকতে পারে। কম মচ্ছব তো আমরা করিনি একসময়। আমাদের ওই ছোট্ট ঘরে প্র্যাকটিস করতে বসলেই বিরক্ত হতো, তখন কতদিন অনিরুদ্ধর ছাদের ঘরে বসে প্র্যাকটিস করেছি। অনেক স্মৃতি ওর সাথে ওর পরিবারের সাথে। দুঃখ একটাই ছেলেটা একটা মনের মতো মানুষ পেল না। বউটা চলে যাওয়ার পর এতটাই গম্ভির, একরোখা, স্বতন্ত্র হয়ে গেল, যে সমাজে থেকেও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কত বার বলেছি, আরে ইয়ার ছোড়, যো গিয়া সো গিয়া, তুই নতুন করে জীবন শুরু কর, তুই নিজে দেখতে পারিস তো বল আমি মেয়ে দেখি। কিন্তু …

            —  বাঁয়ে ঢুকিয়ে দিন, হ্যাঁ ওই যে গাড়ি বারান্দা দেখছেন ওখানে…

            গেট খুলে দাঁড়িয়ে অনিরুদ্ধ। গাড়ি বারান্দার আলো ওর প্রশস্ত টাকে। গোল্ড ফ্রেমের চশমা চকচক করছে। আর বলিষ্ঠ গোঁফের নিচে ঝকঝকে হাসি। ভালো হয়ে গেল মনটা।

            বাংলা বলা, বাংলা শোনার জন্য মুখিয়ে থাকা মনটা প্রায় না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল সারা রাত। সঙ্গে পানীয়। অত রাতেও যে অনিরুদ্ধ খাবার আয়োজন করে রাখবে ভাবতে পারিনি। তাও আমার প্রিয় সব খাবার। শেষ রাতে দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার ঘুম এমনিই কম। সারা রাত অনুষ্ঠান করার অভ্যেস, দুপুরই আমার ঘুমের প্রিয় সময়। ঠিক ছ’টায় ঘুম ভেঙে গেল। ভাবলাম বাড়িতে একবার ফোন করে জানান দিই আমার উপস্থিতি। তারপরেই ভাবি না থাক বরং রিয়া, পর্ণা দুজনের জন্য সারপ্রাইজটা থাক। ওদের গিফটগুলো গতকাল মুম্বাইতে কিনেছি। আমার তো আসার কথা ছিল না, হঠাৎই পাওয়া দিন তিনেকের ছুটি। আমার প্রিয় গৃহকোণ আমায় ডাকছে। অনিরুদ্ধকে না ডেকে পারি না। ও ঘুম থেকে উঠে পড়ে বলে, যাবি রে বাবা যাবি, ফ্রেস হয়ে চা-টা খেয়ে যাবি। আমি দু’মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে যাচ্ছি। তোকে পোঁছে দেব। অগত্যা বাথরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে নিই। বেরিয়ে দেখি অনিরুদ্ধ পোশাক পরছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে ওর স্নান সারা। বলি, তুই শুধু শুধু ব্যস্ত হলি। আমি নিজেই টোটো অটো যা হোক কিছু নিয়ে চলে যেতাম।

ও বলে, না রে, আজ তাড়াতাড়ি উঠতেই হতো।

            — কেন?

            — দিপুকে দেড় দু’মাস ধরে ঝোলাচ্ছি একটা গল্পের জন্য। আর ও নাছোড়বান্দা আমাকে দিয়ে লেখাবেই।

            অনিরুদ্ধর জন্য ফ্রুট জুস আর আমার জন্য চা-জলখাবার চলে আসে। মুখ চালাতে চালাতে অনিরুদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।

            — হাসছিস কেন?

            — কাকে নিয়ে গল্প লিখব বলতো?

            — কাকে নিয়ে?

            — তোকে নিয়ে।

            — আমার জীবনটাই তো গল্প!

            বলে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। অনিরুদ্ধ জিজ্ঞাসা করে, ঘরে ফোন করেছিস।

            বলি, না, সারপ্রাইজ দেব।

            — দূর পাগল এদিক ওদিক কোথাও চলে গেলে কী হবে, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি!

            — এত সকালে কোথায় যাবে?

            — আরে বাবা মেয়েকে টিউশনে বা দুধ আনতে যেতেই পারে … তোকে ফোন করতে হবে না, আমি করে দিচ্ছি…

            বলে, আমাকে সুযোগ না দিয়ে নিজেই ফোন করে আমার উপস্থিতির খবর দিয়ে দেয়।

            — তোর কাছে পর্ণার ফোন নম্বর ছিল!

            — আরে ওর বিউটি ক্লাসের জন্য সার্টিফিকেটগুলো বানায় না আমার কাছে। হোয়াটসঅ্যাপেই তো ম্যাটার পাঠায়। তুই ব্যস্ত হোস না, আরাম করে খা। পর্ণা ঘুমোচ্ছিল সম্ভবত। ও রেডি হোক।

            না, আমি ব্যস্ত হই না। জলখাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়ি অনিরুদ্ধর গাড়িতে। ও গাড়িটা হটন রোডের দিকে ঢুকিয়ে দেয়। কালী বাড়ির বাজারে রবিবারের ভিড়, অনেক বাধা অতিক্রম করে অনিরুদ্ধ পৌঁছে দেয় ফ্ল্যাটের দোরগোরায়। দেখি পর্ণা দাঁড়িয়ে আছে, রিয়া বোধহয় ঘরে ঘুমোচ্ছে। ট্রাকস্যুট পড়ে শৈবাল দাঁড়িয়ে। গাড়ি থেকে নেমে ওকে জিজ্ঞেস করি, এত সকালে তুই।

            — মর্ণিং ওয়াকে বেড়িয়েছিলাম, পর্ণা বলল, তুমি আসছ, দাঁড়িয়ে গেলাম। মালপত্র তুলতে যদি কাজে লাগি।

            অনিরুদ্ধ গাড়ি থেকে নামল না। বলল, প্রয়োজনে ফোন করিস।

            ও বেরিয়ে গেল। আমার এককালের ছাত্র পর্ণার বাল্যবন্ধু শৈবাল আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। প্রায় দু’বছর পরে নিজগৃহে! সিঁড়িতে সবার আগে পর্ণা তারপরে শৈবাল সবার শেষে আমি। ওরা কী আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে?

                                     অনিরুদ্ধদার ফোনটা আমায় অবাক করেছিল। এমনটাতো রাজ কখনো করে না। আসার অন্তত সাত-দশদিন আগে ফোন করে। মুম্বাই আসবে এ কথা বলেছিল কিন্তু আসানসোলে আসার কথা বলেনি। তাহলে কি অনিরুদ্ধদা কিছু বলেছিল। তাই যদি তাহলে অনিরুদ্ধদা ফোন করল কেন? বরং অনিরুদ্ধদা ফোনটা করে দেওয়াতে সুবিধেই হয়েছে আমার। তাহলে কি রাজ কিছু সন্দেহ করেছে? কে বলতে পারে ভেবে ভেবে যখন আমি সারা তখন শৈবাল বলেছিল, ‘আরে বাবা, মেয়ে বউকে সারপ্রাইজ দিতে ইচ্ছে করে না। বয়স যতই হোক মানুষটাতো রোমান্টিক। এই এক ছেলে, বললাম, বাড়ি চলে যা, তা না রিসেপশনের জন্য রয়ে গেল। বলল, ‘ছাড় তো, রাজদা আমাদের ব্যোমভোলা মানুষ কিছুই ভাববে না।’ তবে থাক।

            প্রায় দু’বছর পরে ফিরছে রাজ। দেখতে ছ’বছরের হয়ে গেল রিয়া। রাজ ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত মেয়েকে ছুঁয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। তারপর আলতো করে ঠোঁট দিয়ে ওর কপাল স্পর্শ করল। বলি, ডেকে দিই। বলে, না থাক। আরো একটু ঘুমোক।  স্কুলে যাচ্ছে?

            তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে। ধরতে দিই। কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করে। হালকা কেঁপেও উঠি বোধহয়। কেননা রাজ বলে, কী হল?

            কিছু না! অনেকদিন পর তোমার স্পশর্, তাই বোধহয়!

            অচেনা লাগছে না? হতেই পারে, দু’দুটো বছর বড় কম সময় নয়। আমার ছোট্ট রাজকন্যাটাও অনেক বড় হয়ে গেছে। মোবাইলে দেখে বুঝতে পারিনি, বেটি আমার এতটা বড় হয়ে গেছে। বললে না তো স্কুলে যাচ্ছে?

            যাচ্ছে তো। কখনো আমি, কখনো শৈবাল পৌঁছে দেয়। প্রথম প্রথম কয়েকদিন কান্না কাটি করলেও এখন বলতে হয় না নিজে থেকে তৈরি হয়ে নেয়।

            শৈবাল তোমার খেয়াল রাখে খুব!

            তা কেন! তুমি যখন এখানে ছিলে তখনও তো আসত।

            না, আমি থাকি না। তোমার খুব অসুবিধে। ভাবছি এবার চলে আসব।

            আমি সামলে নিয়েছি। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না, তাছাড়া এখানে ঐ পরিমাণ টাকা তুমি রোজগার করতে পারবে?

             সেটাও ঠিক। এখানে কে দেবে অত টাকা!

            চুপ করে যায় রাজ। আমি  কি বাড়াবাড়ি করে ফেললাম? ঠেকা দিতে বলি, তুমি ফ্রেস হয়ে নাও, জলখাবার রেডি করি।

            ফ্রেস হয়ে জলখাবার খেয়েই এসেছি। তুমি বরং ফ্রেস হয়ে নাও। তোমাদের গিফট গুলো সব ব্যাগে আছে। রিয়া উঠুক তারপর নয় বের করব। আমি বরং আমার রাজকন্যার সাথে একটু গড়িয়ে নিই। কাল রাতে ভাল করে ঘুম হয়নি।

            বলি, সেই ভালো। আমি ফ্রেস হয়ে বাজার করে আনি। অনেকদিন নিশ্চয় বাঙালি খানা খাওনি।

            রাজ ঘুমিয়ে পড়ে। আমি তৈরি হয়ে বাজারে যাই। ফ্ল্যাট থেকে বেরোতেই শৈবালের সাথে দেখা। বলে, আমি তো আসছিলামই, তুই বরং এই কটা দিন রাজদাকে সময় দে।

            বলি, তোকে পাকামি করে ঘন ঘন আসতে হবে না, রাজ সন্দেহ করবে। বাজার আজ আমিই করবো।

            ‘চল তবে’, বলে আমার সঙ্গ নেয়। অগত্যা…

            ফিরে দেখি বাপ-বেটিতে বিছানায় বসে খেলা করছে। তবে রিয়া অনেকটা আড়ষ্ট এখনো। রাজ হাসতে হাসতে বলে, জানো বেটি ঘুম ভেঙে উঠে আমাকে দেখে কী চমকে গেছিল। ভয়ে মুখ শুকিয়ে একাকার। তারপর অনেক বোঝাতে ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখল। কি বেটি বাপিকে চেনা যাচ্ছে।

            রিয়া হাসে। ওর দু’বছর আগের বাপিকে জড়িয়ে ধরে। আমি মনে মনে বলি, দু’বছর অনেকটা সময় রাজ। শুধু টাকাতে কী আর সংসার চলে। আমার শরীরটাও তো শরীর। তুমি  না হয় তোমার খিদে যখন ইচ্ছে মিটিয়ে নিতে পারো আর আমি!

            ঝকঝকে আড়ষ্ট একটা সকাল কেটে গেল। দুপুরে রাজ আমাকে চাইলো। ওর শরীরটা আগের থেকে ভারী হয়েছে। তলপেটে চর্বির স্তর। অ্যালকহলিক ফ্যাট। প্রশ্ন করি, খুব মদ খাচ্ছো আজকাল?

            রাজ হাসে, তেমন নয়, তবে হয়ে যায়। পেশাটাই এমন, চারিদিকে প্রলোভন।

            আর আমি বলতে গিয়ে বলতে পারি না। রাজ আমার শরীরটাকে চাইছে। আমি এগিয়ে দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু সেই আগের মতন নয়, সেই সব দিনে মনের জানালা দরজাগুলোও খুলে যেত, সেটা সংগঠিত হত এক যৌথপ্রচেষ্টায়। সঙ্গমতো তাইই। আমার শরীর কেমন কাঠ কাঠ, সারহীন শব্দহীন। রাজ কী টের পাচ্ছে, যা কিছু ঘটছে সবই ওর প্রচেষ্টা আমার কোন অংশীদারিত্ব নেই। রাজের নগ্নদেহ একসময় থেমে যায়। পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে রাজ। ওর গায়ে চাদর চাপিয়ে ঢেকে দিই নগ্নতা।

            রিয়া গেছে শৈবালের সাথে বেড়াতে। শৈবাল নিয়ে গেছে জোর করে। যাবার আগে অসভ্য ইশারা করে গেছে আমাকে। ফিসফিস করে বলেছে, রাজদাকে সুযোগ করে দিলাম, যতই হোক বিয়ে করা বউ। আদর করতে তো মন চাইবে।

            সজোরে একটা কিল বসিয়ে দিই ওর পিঠে। রাজ তখন ভেতরের ঘরে। রিয়া বেড়াতে যাবার নামে লাফাচ্ছে। মেয়েটা শৈবালের ন্যাওটা হয়ে পড়েছে। সুযোগ পেলেই ওর এনফিল্ডে চেপে ঘুরে বেড়ায়। রাজের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন মায়া হয়। লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে ঘরটা অন্ধকার করে দিয়ে ব্যালকনিতে চলে আসি। দেখি অসময়ে মেঘ করেছে। ছোট ছোট মেঘগুলো ক্রমশ জমা হচ্ছে পশ্চিম কোণে। মোবাইলে ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখি — ষাট শতাংশ বৃষ্টির সম্ভবনা। না, শৈবালকে ফোন করতে হচ্ছে। মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় গেল কে জানে? বৃষ্টিতে ভিজলে আর দেখতে হবে না। সেই ছোট্ট থেকেই মেয়েটার ঠান্ডা লাগার ধাত। অবশ্য শৈবাল সেটা জানে।

            কিন্তু আমার মনের ভেতরের অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। আজ রাতেও এই খেলাটা আমায় খেলতে হবে, কালকেও! অবশ্য এই দু’টো মাত্র দিন। নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিই। তারপর তো সব সেই আগের মতো। আমার মনের কোণেও অস্বস্তির মেঘগুলো জমা হতে থাকে।

                           রাজের গল্পটা লিখতে গিয়ে আমার সব গুলিয়ে গেল। গল্পটা আর শুধুমাত্র রাজের থাকল না। নিজের অজান্তেই অনুপ্রবেশ করে গেলাম আমি। আসলে যার বউ পালিয়ে যায় বা চলে যায়, তার অসম্মানের একটা নিজস্ব জগৎ থাকে। যতই বর্ম পরে বসে থাকি না কেন, উদারতার ঢঙ্কানিনাদ যতই চওড়া হোক না কেন তার ভেতর লুকনো কান্নার সুর চাপা থাকে। আর সেটা অমর্যাদার কান্না।

            আমার জীবনের ওই পর্বটা তো ভোলার নয়। আমার সেই দিনটার কথা মনে পড়ছিল, যে দিন ঐ মেয়েটা দক্ষিণের ঘরে গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিল। ঘটনাচক্রে আমি তখন বাগানে। খোলা জানালা দিয়ে চোখে পড়েছিল দৃশ্যটা। ও নাকি কোনো মুসলমান ছেলের সাথে প্রেম করত, এমনটাই রটে ছিল। আমি কোনো দিন কাউকে এ বিষয়ে একটা কথাও বলিনি। শুধু জানতাম ছেলেটার টাইটেল খান। সে খান তো হিন্দু মুসলমান উভয়েরই টাইটেল হয়। বর্ধমান জেলায় কত হিন্দু খান আছে। দুইজন স্বয়ং সেবক দেখা করেছিল আমার সাথে। জানতে চেয়েছিল আমি কেন থানায় ডায়েরি করিনি। ওরা লাভ জেহাদ নামে একটা বই দেখিয়েছিল। দিয়েও ছিল। বলেছিল, ‘আপনাদের মতো মানুষরা যদি রুখে না দাঁড়ান, এরা ধর্মের নামে আরো অনেকের ঘর ভাঙবে, আপনি বলবেন এটা আপনার ব্যক্তিগত সমস্যা, কিন্তু না। এটা হিন্দু সমাজের সমস্যা। আমরা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না।’ আমার মাথায় তখন তীব্র যন্ত্রণা, ইচ্ছে করছিল লোক দুটোকে ধরে পিটিয়ে দিই। কিন্তু নিজেকে সংযত করে, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠাতে হয়েছিল। ওদের কে কী করে বলি, যে মেয়েটা আজীবন টেকো লোকেদের অপচ্ছন্দ করে এসেছে, সে কী করে শুধুমাত্র টাকার জন্য একটা পুরো জীবন আমার মতো টেকো মানুষের সাথে কাটাবে! বাস্তবিক পক্ষে আমি জানি না মেয়েটা সেদিন কেন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। আমার কোন প্রশ্নের কোন উত্তরই সে দেয়নি সেদিন। আমি ওর বাপের বাড়ি ছেড়ে আসতে চেয়েছিলাম, ও রাজি হয়নি। আমি শুধু বলেছিলাম, তুমি চাইলে যেখানে খুশি চলে যেতে পারো। শুধু একটা হাত চিঠি লিখে যেও, যাতে আমি তোমার বাবা-মাকে দেখাতে পারি। ও তাই করেছিল।

             ভেবেছিলাম সব বিবর্ণ অতীত। ধুলোধুসরিত সেই অবাঞ্ছিত অতীত রাজের গল্পে কীভাবে যেন ঢুকে পড়ল। গল্পটা আর রাজের থাকল না। ওর স্বপ্ন, ওর স্বপ্নের উড়ানের একটা গল্প আছে। বলেছিল রাজ আমাকে, ছ’সাত বছর আরবে থাকতে পারলে আর চিন্তা নেই। এখানে এসে শুধুই তবলা…’ ওর সেই স্বপ্নটা, স্বপ্নের সেই ঔজ্জ্বল্য এবার চোখে পড়েনি। ও যেন ঐ জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যেমন পর্ণা, যে কিনা রাজ বিনা জীবনে অভ্যস্ত হতে হতে নিজের অজান্তেই জড়িয়ে ধরেছে শৈবালকে। ঠিক যেমন আমি। গল্পটা এভাবেই রাজের থেকে আমার জীবনে উঁকি ঝুঁকি মেরে দিশা হারাল। শেষটা কেমন যেন ঘেঁটে গেল। দিপুকে সে কথায় বললাম।

                                               অনিরুদ্ধ ফোন করেছিল আজকে। ওর ঘরে বিশেষ আমন্ত্রণ রাতে। রাজের অনারে পার্টি। আর কেউ নয়। আমি, ও নিজে আর রাজ। সকালে ফ্লাইট রাজের। রাতে ওর ওখানে খাওয়া দাওয়া করে রাজকে রাতে রওনা করে দেবে ওর গাড়িতে। বলি, সে তো না হয় হল। আমার গল্পের কী হল?

            লিখে ফেলেছি। কিন্তু শেষে এসে কেমন ভেবলে গেছি। গোটা ব্যাপারটা ঘেঁটে ঘ। তুই তো আসছিস তখন না হয় পড়ে দেখে নিবি। আসলে শেষটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। জীবন, অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি সব মিলেমিশেই তো জীবন আর তার সাথে এই মৃত শিল্পশহরটাও কেমন করে যেন ঢুকে পড়ল…

            তাতে ক্ষতি কি হয়েছে? তাছাড়া শহর মৃত বা হতে যাবে কেন? চারিদিকে এত রঙ, এত আলো …

            শুধু আমাদের শহরটা নয়, গোটা দেশটাই ধুঁকছে। বেহাল অর্থনীতি, জাত, ধর্ম, অবিশ্বাসের বিষ মানুষের মনে তার সাথে নীতি আদর্শহীন রাজনীতি…, না লিখে ভালোই ছিলাম রে…, ভেবেছিলাম আমি একটা কেজো মানুষ, উপলব্ধি, অনুভ‚তি যতোসব বাজে শব্দ! অথচ লিখতে বসতেই সব কেমন ধেয়ে এল। লিখতে বসলাম রাজের একটা সাদামাটা উড়ানের গল্প, ওর জীবনের মতোই গল্পটা ঘেঁটে গেল।

            ভালোই হয়েছে। শোন আমি তো রাতে যাচ্ছিই তখন বসা যাবে।

            তুই রুমাকে বলে আয়। রাতে কিন্তু ফিরবি না।

            ঠিক আছে রে বাবা, আজ থাকবো। তোর গল্পটার জন্য না হয়।

            কথা মতো পৌঁছে গেলাম। রাজ তখনও আসেনি। এলাহি আয়োজন! তিনজন মানুষ আর দশজনের আয়োজন। অনিরুদ্ধের বিত্তের মতই বড় ওর মন। তবলা হারমোনিয়ামও রয়েছে। বলি, গান বাজনা হবে নাকি?

            — যেখানে রাজের মতো তবলিয়া উপস্থিত থাকবে, সেখানে একটু গান-বাজনা হবে না।

            — তো তোর সেই রাজ কই।

            — আসছে, একটু আগেই ফোন করেছিলাম। বলল, শৈবালের এনফিল্ডে আসছে।

            — শৈবাল! সে আবার কে?

            — সে এই গল্পে খুবই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বন্ধু। বাল্যবন্ধু তথা প্রেমিকা যখন তার গুরু রাজের সৌন্দর্যে ব্যক্তিত্বে প্রেমে অন্ধ হয়ে বিয়ে করে ফেলছে তখনও সে পালিয়ে যায়নি, বা নিজেকে নষ্ট করেনি, বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলেছে এখনও। আর এই কারণেই গল্পের শেষটা ঘেঁটে যাচ্ছে।

            — তারমানে এই শৈবাল গান গাইবে?

            — না বন্ধু, এই আসরে ওর অনুমতী নেই, এ আমদের মধ্যবয়সিদের আসর।

            — তাহলে গান কে গাইবে?

            — ওটা সারপ্রাইজ। তুই বরং রাজ আসার আগে গল্পটা পড়ে ফেল।

            রাজ লেখাটা বাড়িয়ে দেয়। গল্পটা শুরু করেছে অনিরুদ্ধ রাজের বাবার একটা গল্প দিয়ে — সেই পূর্ববাংলা থেকে আসা একজন শিল্পী মানুষ বার্ণপুর ইস্পাত কারখানায় লেবারের কাজ জুটিয়ে যখন জীবন শুরু করছেন… শিল্প খনিশহরের অস্থিমজ্জায় ঢুকে পড়েছে অনিরুদ্ধ, আমি ডুবে যাচ্ছি…

            বাইরে এনফিল্ডের গম গম শব্দ।  রাজ এল বোধহয়। আমার পড়া প্রায় শেষ শেষাংশটুকু পড়া বাকি… রাজের প্রবেশ। সত্যিই রাজকীয় চেহারা। পরনে চুড়িদার পাঞ্জাবি — মেহেফিলের মুডে, পারফিউমের গন্ধে ভরে যায় ঘর।

            আলাপ করিয়ে দেয় অনিরুদ্ধ রাজের সাথে। রাজ কিছুটা অবাক হয় আমি ওকে জানতাম না, বলায়। বলে এই শহর কিন্তু এখনও আমাকে চেনে এই দু’দিনে বহুজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে সবাই বলেছে, একটু মোটা হলেও আমি সেই আগের মতোই আছি।

            বুঝি শরীর নিয়ে যথেষ্ট গর্ব আছে রাজের। আস্বস্ত করি ওকে। বলি, আসলে সময়ের বিচারে এই শহরে আমি নতুন। ভ‚মিপুত্র  নই। মাস্টারি করতে এই শহরে আসা, আপনার এই বন্ধুটির সাথে অনেকদিনের পরিচয়। সেই কলেজ জীবন থেকে।

            আরে ছিঃ ছিঃ আপনি আপনি করে বলো না, তুই না হোক তুমি করে বলো। না হলে বন্ধু হওয়া যাবে না।

            আমি হাসি। অনিরুদ্ধ পেগ সাজিয়ে ফেলেছে। এলাহি চাট। বলে, ফাস্ট রাউন্ডের পর গান। দ্রæত শেষ হয় ফাস্ট রাউন্ড। আমারটা শেষ হয় না। অনিরুদ্ধ শেষ করার ইঙ্গিত করে। বলি, থাক না, আমি তো আর গান গাইব না।

            আমাকে অবাক করে হারমোনিয়াম ধরে অনিরুদ্ধ। যথেষ্ট ওস্তাদি ঢঙে বাজিয়ে গান ধরে, ইয়ে ন্য থি হ্যমারি কিসমত কে ভিসাল ইয়ার হোতা আগর অওর জিতে রাহেত ইয়েহি ইনেতজার হোতা…

            আরে এতো গালিব। শব্দের উচ্চারণ বুঝিয়ে দিচ্ছে অনিরুদ্ধ কতটা হৃদয় দিয়ে এই শের বলছে, গাইছে, ক্রমশ তবলায় বোল তোলে রাজ … এক বিষণœতার ছোঁয়ায় আসর জমে যায়। শব্দের শরীর মিশে যায় আমি।

            গানের আসর শেষ হয়েছে। পানের আসর শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে কথপোকথন। অনিরুদ্ধ বলে, রাজ তোকে নিয়ে গল্প লিখতে গিয়ে গল্পটা আর তোর থাকল না আমারও গল্প হয়ে গেল এমন কি এই শহরটার, তোর সীতারামপুরের বাইজিটারও।

            পড়ে শোনা, অনেক দিন গল্প পরিনি। যদিও ইন্টারনেটের কল্যাণে পৃথিবীটা ছোট হয়ে গেছে, চাইলেই পড়া যায়, কিন্তু ইচ্ছে করে না। পড় গল্পটা পড়।

            আমি পড়ব না। দিপু পড়বে। ওর তো গল্পটা একবার পড়া হয়ে গেছে অসুবিধা হবে না। আমারও শোনা হবে … কেমন লিখলাম বুঝতে পারবো।

            আমি কিছু অবাক হই, এমন অনেক কথা আছে যাতে রাজ অসন্তুষ্ট হতে পারে। অবশ্য রাজকে আমি চিনিই বা কতটুকু। অনিরুদ্ধ যখন বলছে … শুরু করি পড়া …

            গল্পের শেষ পর্বে এসে রাজ থামাল, তারমানে তুই জানতিস অনি, পর্ণা আর আমার নেই, এমন কী ঐটুকু মেয়েটাও তার বাবাকে ভুলে গেছে…

            আমি বললে তুই বিশ্বাস করতিস কী করতিস না সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু আমি বলতাম তোকে কী করে? সম্পর্ক কী বলে বোঝানো যায়, উপলব্ধি করতে হয়।

            তুই আমাকে অবাক করেছিস, যেখানে তোর গল্পের রাজ উপলব্ধি করছে সে একটা মৃত দেহের সাথে শুয়ে আছে। কাল দুপুরে কিছু বুঝিনি কিন্তু কাল রাতে …! একটা গল্পে পড়েছিলাম মর্গে এক টুকটুকে রূপসীর দেহে উঠে বসছে এক নরপিশাচ। নিজেকে ঠিক তেমনই মনে হয়েছিল কাল। ঘরের রাতের অস্পষ্ট আলো, আমার শরীরটা গাঁথা রয়েছে পর্ণার শরীরে, ওর যোনী, ওর স্তন সব দখল করে রেখেছি আমি, ওর মুখটা এক পাশে হেলান, স্পষ্ট দেখলাম তির তির করে কাঁপছে ওর ঠোঁট, চোখ বন্ধ। বুঝতে পারলাম দেহটার মধ্যে কোথাও পর্ণা নেই। আমার যৌনতাপ, যৌন ইচ্ছা, শরীরবোধ সব নিশ্চিহৃ হয়ে গেল। শরীরটাকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। জানিস অনি, বাবার মৃত্যুর পর এই প্রথম আমি কাঁদলাম, এই ঠান্ডাতেও ফুল সাওয়ারের নীচে…।

            অনিরুদ্ধর হাতটা রাজের কাঁধে। বলে, সেই কারণেই তোকে বলিনি, জানি তুই কষ্ট পাবি।

            না রে সামলে নিয়েছি। গল্পটা শেষ করো দিপু।

            অনিরুদ্ধ বলে, তুই তো যাবি দমদম হয়ে। আমার গল্পের রাজ যাবে অন্ডাল থেকে মুম্বাই এর ফ্লাইটে বিকেল বেলায়।

            আমি পড়ি — এক অবাঞ্ছিত, অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মতো মনে হয় নিজেকে, এ শহর আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে শূন্য হাতে। জানালা দিয়ে দেখছি ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে আমার শহর — যেন আমাকে ব্যঙ্গ করে বলছে — যা রোজগার করে নিয়ে আয়, এ শহরে তোর খাবার নেই, মন নেই…

            থাক!

            থামিয়ে দেয় রাজ। নীচু স্বরে বলে, আমি বোধহয় আর ফিরছি না অনি…

            গজলের সুরের রেশটা রয়ে গেছে। আর তার মাঝে বসে থাকে এক সম্পাদক, এক গল্পকার আর  গল্পের প্রধান চরিত্র। ঝরে পড়ে নিস্তব্ধতা।


লেখক পরিচিতিদিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, আসানসোলের বাসিন্দা। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজে গল্প লিখছেন এবং সম্পাদনা করছেন “দেখা গল্পবার্ষিক”। প্রকাশিত গল্প সঙ্গকলন-বিবমিষা। 
আরও পড়ুন….
দেবেশ রায় : বিপরীত স্রোতের গল্পকার- রাজু বিশ্বাস
অস্তরাগ ।। সৈয়দ কামরুল হাসান
শাড়ি ।। আমিনুল ইসলাম সেলিম
লাল পাসপোর্ট ।। গাজী মহিবুর রহমান

About the author

নরসুন্দা ডটকম