বিয়ের বয়স সবে ২৩ দিন হল । হাতের মেহেদির রঙ ছোপ ছোপ হয়ে মুছে গেলেও এখনও সব কিছু একেবারেই নতুন । ঝকঝকে তকতকে কালো মেঝের উপর তখনও হাসছে আমাদের বিয়ের রঙিন আলপনা। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলে এখনও বাতাসে এক মিষ্টি চাপা গন্ধ টের পাই । নতুন জীবনের গন্ধে সবকিছুকেই নতুন মনে হয় ।
বরকে এখনও ভাল করে চেনায় হল না ।কাল সে চলে যাচ্ছে , রাত নয় টায় ফ্লাইট ।গ্রামের বাড়ি থেকে আজ এসে বড় দাদা মানে বরের বড় ভাইয়ের বাসায় উঠেছি আমরা । এয়ারপোর্ট থেকে দাদার বাসা খুব একটা দূরে নয় । যানজটের ঝামেলা না থাকলে ,আধা ঘণ্টার মধ্যে দিব্যি এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাওয়া যায় ।
দাদার বাসায় যে ঘরটা আমাদের শোবার জন্য দেয়া হল তাতে বড় বড় কালো রঙের লাগেজ গুলো দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে । রাজ্যের জিনিস ঢুকানো হয়েছে বলে লাগেজের সামনের দিকটা সামান্য উঁচু হয়ে পেটের মত ফুলে আছে । আমাদের সন্ধ্যা ছয় টায় বাসা থেকে বের হলেই চলবে । বাসা থেকে বের হবার আগে বর লাগেজ গুলোর ওজনটা একটু পরখ করে নিল । ওজন বেশী হলে এ নিয়ে পরে আবার অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে । দাদা -ভাবী আর উনাদের দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যথারীতি ছয় টায় বের হলাম ।
এয়ারপোর্টে গিয়ে বোডিং পাস নেয়া যখন শেষ হল, তখন ভিতরে বিদায়ের কষ্টটা যেন আমার নড়েচড়ে বসল। আমাদের একদম সামনে বসতে দিয়ে দাদা- ভাবী একটু দূরে গিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে বসলেন ।
আমি তখনও বুঝতে পারছি না বর চলে গেলে আমার ঠিক কেমন লাগবে । এ কয়েকদিনে কি যেন এক যাদু ঘটে গেল এই মানুষটার সঙ্গে ! আড়াল থেকে কে যে ঘটাল এই যাদু, কেইবা জানে । অচেনা অপরিচিত এক মানুষ যাকে কিছুদিন আগেও চিনতাম না সে কি করে এক নিমিষে এত আপন হয়ে উঠে ! রক্তহীন সম্পর্কের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে মনে হল এ যেন ছোটবেলায় দাদুর মুখে শোনা রূপকথার সেই রুপোর কাঠি আর সোনার কাঠি নাড়িয়ে দেবার মত এক যাদু! সম্পর্কের সেই রুপোর কাঠি আর সোনার কাঠি নড়ে উঠলেই যেন অদৃশ্য সুতার বুননে একে অপরকে বাঁধতে শুরু করে । এ কয়েকদিনে সে যে আমার মনের সবকটা জমি কিনে নিয়ে তাতে ইটের পর ইট গেঁথে মস্ত দালান তুলেছে !
ও চলে গেলে আমার খুব একা লাগবে জানি, শূন্য লাগবে সব কিছু । ভাবতে ভাবতে ভিতরটা কেমন যেন ভেঙ্গে চূড়ে গেল । ভাঙ্গনের আওয়াজটাও বুঝি কানে এসে লাগছে । তবে বরকে অন্য সময়ের মতই আমার স্বাভাবিক লাগছিল । তার সাথে হাজারও আবোলতাবোল , যুক্তিহীন কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল , সে কি আমার মনের ভাংচুরের শব্দটা শুনতে পারছে ? নাকি পারছে না ।
এয়ারপোর্টে কমলা রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার গুলো সারি সারি করে সাজানো । আমরা বসেছি একদম সামনের সারিতে । চারপাশে অপরিচিত সব মুখ। একটু খেয়াল করলে চোখে পড়ে প্রিয়জনদের বিদায় দিতে আসা ব্যথিত সব মানুষজন । অপরদিকে অনেক দিনপর প্রিয়জনদের আবার বাড়ি ফিরিয়ে নিতে আসা, চোখেমুখে আনন্দ -ঝলমল করা অনেক উৎসাহী মানুষ । আমার পাশের চেয়ারে বসা এক মা তার ছেলেকে মোটা কাঁচের দেয়ালের ভিতর দিয়ে যতক্ষণ দেখা যায় ঠিক ততক্ষণ পলকহীনভাবে , প্রাণ ভরে যেন দেখে নিচ্ছে। এসব দেখে মনে হল বিদায় কষ্টের হলেও এর মাঝেও একটা লুকানো সৌন্দর্যতাও আছে । আমরা কেবল কষ্টটাই দেখি বলে, বিদায়ের সত্যিকারের রূপটা আমাদের চোখে পড়ে না ।
ঠিক সাত টায় নারী কণ্ঠের একটা ঘোষণা শুনতে পেলাম । সব যাত্রীদের তাদের নিজ নিজ ফ্লাইট অনুযায়ী তাদেরকে ইমিগ্রেশান এ যাবার জন্য তৈরি হতে বলল । পরপর কয়েকবার এই ঘোষণাটি শোনার পর বরকে বললাম ,
___ তোমার তো এবার যাবার সময় হয়ে গেল , এবার উঠে পড় ।
___ অসুবিধা নেই , দেরি হবে না , আর একটু বসি না হয়, । এই বলে সে চিন্তাহীন ভাবে বসে রইল ।
সমস্ত পৃথিবী উপেক্ষা করে আমাদের কথা এগুচ্ছে । হঠাৎ টের পেলাম সে আমার হাতটা চেপে ধরল । তার মাংসল পেশী ফুলানো শক্ত আঙ্গুল গুলো আমার হাতের আঙ্গুল গুলোকে খুব শক্ত করে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরেছে ।
___ এবার উঠে যাও , নইলে দেরি হয়ে যাবে।
অপার মায়া জোড়ানো মুখে স্মান হেসে সে বলল , __ হুম , যাব । এইতো এখুনি উঠছি । এই বলে আবারও সে হাত ধরে বসে রইল । কথা তখনও চলছে ……
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমরা যেখানে বসেছি ঠিক তার সামনেই একটা ছোট দোকানের মত ছিল যেখানে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু কিনতে পাওয়া যায় । বড় দাদা একটা পানির বোতল কিনে একটু দূর দিয়ে মাথা নিচু করে আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন । ও আমার হাত ধরে বসে থাকায় আমার বেশ লজ্জা করছিল সত্যি কিন্তু আমার আঙুল গুলোকে তার হাত থেকে কোন ভাবেই ছাড়াতে পারছিলাম না । দাদা চলে যাবার পর বর উদাসীন ভাবে বলে উঠল , ___ কিছুক্ষণ আগে যে লোকটা পানির বোতল হাতে নিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে গেল , উনি দেখতে একদম বড় দাদার মত, তাই না ? আমি স্মান হেসে বললাম, ___ উনি দাদার মত না, উনি দাদাই ! এ কথা শুনে বর যেন একটু নড়েচড়ে বসল ।
ঘড়িতে তখন প্রায় ৮ টা বাজে । ও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইমিগ্রেশান এর জন্য ভিতরে ঢুকে গেল । আমি দূর থেকে কাঁচের ভিতর দিয়ে ওকে দেখছিলাম । আমার ভিতরে তখন হু হু করে বাতাস বইতে শুরু করেছে আর সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে কেমন যেন সব শূন্য করে দিচ্ছে ।
হঠাৎ বিপত্তিটা চোখে পড়ল । মোটা স্বচ্ছ কাঁচের ভিতর দিয়ে বরকে খুব চিন্তিত লাগছে । এদিক – ওদিক ছুটাছুটি করে , কাস্টম অফিসারদের সাথে চিন্তিত মুখে কি যেন কথা বলছে ! ঘড়িতে তখন সাড়ে আট টা বাজে । এ- সব দেখে আমাদের সবার চোখে -মুখে চিন্তার ছাপ । কি ঝামেলা হচ্ছে ভিতরে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না ।
এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর বরকে কাঁচের দরজা ঢেলে আমাদের দিকে হাসিহীন মুখে এগিয়ে এসে বড় দাদাকে বলতে শুনলাম ,
__ দাদা ! আমি উঠতে অনেক দেরি করে ফেলেছি । ইতিমধ্যে প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে । আমি আজ আর যেতে পারব না !
এ কথা শুনে সবাই তো হতবাক ! এমা ! বলে কি ছেলে । ফ্লাইট মিস হল ! এবার টিকিটের কি হবে ? এত টাকার টিকিট ! এসব নিয়ে সবার মনে হাজারো দুশ্চিন্তার প্রশ্ন এসে জড়ো হতে লাগল ।
যতদূর জানি , বরকে বাসার সবাই একটু আলাদা নজরে দেখে তার দায়িত্বশীলতার জন্যে । আর সে কিনা প্লেন মিস করেছে তাও আবার নিজের কারণে ! এ অবাক হবার মত ব্যাপার বটে !
তারপর কি আর করা , যাবার আর কোন সম্ভবনা না দেখে , চিন্তিত মুখে , লাগেজ নিয়ে এবার বাসায় ফিরার পালা । আসার পথে সবাই চুপচাপ আর চিন্তিত থাকায় ,গাড়িতে একটা থমথমে ভাব লেগে আছে । কিন্তু রহস্যজনকভাবে আমার কেন জানি ভিতরে ভিতরে খুব আনন্দ হচ্ছে । মানুষটাকে হয়ত আরও কিছুদিন চোখের সামনে দেখতে পাব । পরদিন বড় দাদা পুরনো টিকিটের টাকায় আবারও আর একটা নতুন টিকিট করে দিলেন । এবার বর ৭ দিন পর ফ্লাইট পেল । এদিকে বাসায় আত্মীয় – স্বজনরা অধীর আগ্রহে ফোন করে জানতে চাইছে কেন ফ্লাইট মিস হল ? কি কারণ ? পাশের ঘর থেকে বড় ভাবির হাসির শব্দ শুনা যায় । সবাইকে কারণ বলতে গিয়ে ওনি হেসে হেসে উত্তর দিচ্ছেন , __ আরে , এই হল বিয়ের ঘোর ! নতুন বউকে রেখে যেতে মন চাইছে না তাই ইচ্ছে করে প্লেন মিস করেছে , সাতদিন পর যাবে । আরও কত কিছু যে আমরা দেখব ভবিষ্যতে কে জানে ।
এসব শুনে আমার খুব লজ্জা হচ্ছে , তবে কেন জানি ভিতরে ভিতরে ভীষণ রকম একটা চাপা আনন্দ ও কাজ করছে । যাক , আরও সাত দিন তো কাছে পাব মানুষটাকে ! এ তো বিশাল কিছু !
ঠিক তার এক দিন পর আমরা ট্রেন দিয়ে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি ফিরছি । ট্রেন ভ্রমন এমনিতেই আমার খুব প্রিয় তার উপর সদ্য বিবাহিত বর পাশে । এ তো চাঁদ ছুঁয়ে দেখার মতই আনন্দের ! এটা ভাবতে ভাবতে পৃথিবীর সব দুঃখ – কষ্ট যেন আমার মন থেকে কিছুক্ষণের জন্য একেবারেই উবে গেল ।
বেলা তখন দুপুর গড়িয়েছে , ট্রেন গা ঝাঁকিয়ে দুলে দুলে চলছে । বাইরে শরতের টলমলে রোদে ধান ক্ষেত গুলো যেন আজ আরও সবুজ হয়ে উঠেছে ! আর সবুজ রঙ ছড়াতে ছড়াতে ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছে।
ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঝিমুনি পেয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি । যখন ঘুম ভাঙল দেখি বর একটু অপ্রস্তুত চোখে এদিক- ওদিক তাকিয়ে আমার কানের কাছে মুখ এনে মৃদু সুরে বলছে ,
___ তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে , ট্রেনের সবাই তোমাকে খুব খেয়াল করেছে , জানো ?
___ আমাকে খেয়াল করার কি আছে ? আমি কি চিড়িয়াখানার প্রাণী ? তুমি কি আজব কোন প্রাণীকে বিয়ে করেছ ? কথাটা হেসেই বললাম ।
___ না , না , তা বলিনি । বললাম তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে তখন তুমি আমার এক হাত জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলে , তাই ।
__ ওমা , তাই বুঝি ! তো কি হয়েছে ? আমি কি ঘুমের ঘোরে অন্য কারোর বরের কাঁধে মাথা রেখেছি ? এ কথা শুনে বর স্মান হেসে চুপ করে গেল । এই সুযোগে আমি চারপাশটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম । ট্রেনের কামরায় উৎসুক অনেক জোড়া চোখ আমাদের তখন ঘিরে আছে ! কেউ কেউ খবরের কাগজের আড়ালে মুখ ঢেকে হাসি লুকাচ্ছে । আবার আমার চোখে চোখ পড়তেই কেউ কেউ মুচকি হেসে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে ।
বর হঠাৎ উদাসীনভাবে বলে উঠল, ___ একটা কথা বলব তোমায় ?
__ বলো ।
__ তুমি যখন আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলে তখন তোমার কপালের লাল বড় টিপটাকে আমার কাছে ঠিক গোধূলির লাল সূর্যের মত লাগছিল । মনে হচ্ছিল সূর্যটা যেন ক্লান্ত হয়ে তার সবকটা রঙ ছড়িয়ে আমার বুকের উপর ঢলে পড়েছে !
এ কথা শুনে মনের মধ্যে যেন আনন্দের বিদ্যুৎ চমকালো । মনে মনে বললাম, যাক বাবা, তোমায় যতখানি নিরামিষ ভেবেছিলাম তুমি ততখানি নিরামিষ নও তাহলে !
বাড়ি ফেরার পথে ইতিমধ্যে সন্ধ্যা গোধূলির রঙ মুছে দিয়ে, চারপাশে কালো হয়ে নামতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার গায়ে মেখে,জানালার একধারে ধান ক্ষেত আর তাদের সাথে গাছ পালার দৌড় দেখতে দেখতে, ওর কাঁধে মাথা রেখে , ট্রেনের দুলুনিতে দুলে দুলে সেদিন দুজনে বাড়ি ফিরেছিলাম ।