‘আজ শরতের কাশের বনে হাওয়ার লুটোপুটি
মন রয়না রয়না এই বিদেশে, চায় যে এবার ছুটি’
এই মেঘ এই রোদ এই বৃষ্টি – শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের লুকোচুরি। ষড়ঋতুর এই দেশে প্রকৃতি বর্ণময় রঙের পসরায় সাজে। কখনও কালবৈশাখীর র্রূদ্র ভয়াল কালো মূুর্তিতে, বর্ষায় অঝোর ধারায় বিজলী চমকে, নীলাম্বরী রঙের আকাশে শিমূল তুলার মত সাদা রঙের মেঘে, কখনওবা রিক্তশীর্ণ প্রকৃতি সবুজে সেজে ওঠে পাখির কলতান আর কৃষ্নচূড়ার আগুন রঙের ফুলে।
‘‘মেঘমুক্ত সাদা আসমানে শূঁড় তুলে-,
পথিকেরে ডাকিতেছে শান্ত ঐরাবতী-
এসো ভাই, এসো বোন, আমরা তো সবাই
কাশবনের বাসিন্দা-; এই প্রকৃতির বুকে
আমরা সবাই তো তাঁরই সন্তান-সন্ততি।’’
ব্যস্ত নগর ঢাকার সবকিছুই যেন চলে দ্রুত লয়ে কিন্তু ঋতুর রঙ বদলে থাকে পিছিয়ে। বিশেষত শরতের সতন্ত্র অস্তিত্ব এ নগরীতে চোখে পড়ে সামান্যই। মিরপুর থেকে আশুলিয়ার পথে, আমিনবাজারের পর মধুমতি মডেল টাউনের দু‘পাশে আর কেরানীগঞ্জে হাউজিং এর জন্য জলাভূমির পাশে কাশবনের দেখা মেলে।
সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি ছবির সেই বিখ্যাত ট্রেন দৃশ্যও তরুণদের আগ্রহী করতে পারে। অপু-দুর্গার মতো এক ছুট লাগাতে ইচ্ছা হতে পারে কাশবনের ফাঁক দিয়ে।
‘‘পুচ্ছ তোলা পাখির মতো
কাশবনের এক কন্যে,
তুলছে কাশের ময়ূরচূড়া
কালো খোঁপার জন্যে।’’
সন্ধ্যার আগে আগে কাশফুলের বন দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। অদ্ভুত সুন্দরের খোঁজেই কাশফুলের রাজ্যে যাচ্ছেন অনেকে। এ সুযোগে কেউ আরও একবার দুটো লাইন ধার করতে পারেন কাশফুলের কাব্য থেকে-
‘‘তোমার হাতে বন্দী আমার
ভালোবাসার কাশ
তাই তো আমি এই শরতে তোমার ক্রীতদাস।’’
কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে, চরে দিগন্ত জোড়া কাশবনের বিস্তার যেন নৈসর্গিক ভাবে রচিত কাশবন কাব্য। আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টির তুমুল ঝড়-ঝাপটা কমে গেলে বদলে যায় আকাশের দৃশ্যপট। স্বচ্ছ আকাশে যাযাবর মেঘ দেখে মনে হয় নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা? এই আশ্বিনে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের গ্রামে থাকে শীতের আমেজ। শারদীয় দূর্গাপুজায় ঢাকের শব্দ, লক্ষীপুজোয় কোজাগরী পূুর্ণিমায় প্রকাশিত সাদা নিয়ন স্নিগ্ধ আলো অপার্থিব।
ব্যস্ত নগর ঢাকা থেকে এক সকালে কাশবন দেখতে যাত্রা করি ময়মনসিংহে। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের ডান তীরের দীর্ঘ অংশ এখন বাঁধাই করা হয়েছে। নদের তীর ধরে শম্ভুগঞ্জ সড়ক সেতু থেকে হেঁটে আসা আসা যায়। অনেক আলো –-আঁধারের ভোর, সকাল, নির্জন দুপুর, জ্যোৎস্না রাত শিল্পাচার্য – ময়মনসিংহের জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা চত্বরে কাটিয়েছেন। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র ছিল তাঁর প্রেরণা।
নদের উপর নির্মিত সেতুর দু’পাশে সুবিস্তৃত কাশবন। সার্কিট হাউজের পাশ থেকে নদের ওপাড়ে আজিজের নৌকায় পার হয়ে নির্জন বিকালে ব্রহ্মপুত্র নদের পানিতে পা ডুবিয়ে কাশবনে হারিয়ে যাওয়া যেন অপার্থিব , স্মৃতিতে অনেকদিন ধরে রাখার মতো বর্ণময়। উপরে স্নিগ্ধ নীল- সাদা আকাশ, একপাশে হিমালয় থেকে বয়ে আসা বহমান নদ, পাশে কাশবনের সবুজ ঘাসে সাদা ধূসর ফুলের মহাকাব্য। মহাভারতে এই ব্রহ্মপুত্র নদের জন্ম নিয়ে রয়েছে কিংবদন্তি। মাতৃহত্যার দায় থেকে পরশুরাম শাপমুক্ত হয়েছিলেন হিমালয় কেটে ব্রহ্মপুত্র নদকে সাগরের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার মধ্যদিয়ে।
এ নদের স্বচ্ছ কাকচক্ষু পানিতে যেন শুভ্র নীল আকাশের প্রতিবিম্ব পড়ে। আশে পাশের গ্রামে চরে ফসলের বিস্তৃর্ণ সবুজ ভূদৃশ্য। নদীর পাড় ধরে শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে নৌকায় এগিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে দেখা মেলে ভেজা শিউলি ফুলের। শিউলি ফুলের জাফরানী রঙের বোঁটায় সবুজ ঘাসের উপর যেন নরম বিছানা।
ফারুখ আহমেদ লিখেছেন-
‘শিউলি-কথা’ য়
‘‘হাওয়া উঠছে শিশিরে শিরশিরিয়ে
শিউলির গন্ধ এসে লাগে
যেন কার ঠা-া হাতের কমল সেবা।’’
আমাদের অনেকের জীবনেই শিউলি ফুল নিয়ে এমন অনেক ঘটনা, স্মৃতিকথা আছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিউলিমালা পড়ে আমি নিজে শরৎ মৌসুমে শিউলি ফুল ফুটলে সে ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে একটি পুকুরে ভাসিয়ে দিতাম কোনো এক অদৃশ্য প্রেমিকার উদ্দেশে। এখনও শরতের ভোরে একটু শীত পড়ে। আমাদের ছেলেবেলার যেশহরটায় বেড়ে উঠেছি তার চারপাশ ছিল গাছগাছালিতে ঘেরা। শীতও পড়ত অনেক বেশি। তখন প্রায় সময় প্রাইমারী স্কুলের পাশের বাদল বাবুর পুকুরের কাছের শিউলিতলায়, শীতে জড়োসড়ো হয়ে চাদর গায়ে কুয়াশাভেজা ভোরবেলায় শিউলি ফুল কুড়াতাম। দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই সে ফুল নিয়ে বাসায় ফিরতাম। শিউলি ফুলের ডাঁটা দিয়ে বাঁশি বাজানো যায়।
আমরা মজা করে বাঁশি বাজাতাম। তারপর বাসায় ফিরে ফুলের বোঁটা দিয়ে কাগজে দাগ দিয়ে নানা রকম আঁকিবুঁকি করতাম। চমৎকার সে জলরঙের ছবি এখনও চোখে লেগে আছে। শিউলি ফুলের গঠন এমন যে, সুতো ছাড়াও ফুলের ওপর বোঁটা গেঁথে গেঁথে মালা তৈরি করা যায়। আমরাও তেমন মালা গাঁথতাম। বিনিসুতোর মালা। ইট-কংক্রিটের শহরে এখন সেসব শুধুই স্মৃতি। ইটের পর ইট গেঁথে বিশাল ইমারত গড়ে উঠেছে। প্রায় বাড়িতে থাকা শিউলি ফুলগাছ এখন আর নেই বললেই চলে। বছর কয়েক পূর্বে ভুটান ভ্রমণ শেষে ফুন্টসলিং এর এর একটি হোটেলে চোখে পড়ে বিশাল একটি শিউলি গাছ। ঘুম ভেঙ্গে যায় সেদিন খুব সকাল সকাল। আমি সে গাছে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখি।
প্রায় ভোরের আলো- অন্ধকারে হোটেলের সীমানায় চোখে পড়ে শিউলিফুল যেন চাদরের মতো হয়ে বিছিয়ে রয়েছে। এমনভাবে শিউলি ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে, যেন সাদা আর জাফরানী রঙের শিউলি ফুলের বিছানা। শিউলি ফুল এমনই। মাঝারি আকারের গাছ। পাতার উপরের অংশটুকু কিছুটা সূচালো। ফুলগুলো ঘন রোয়াযুক্ত। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখি। তারপর নিবিড় আবেশ বুকে নিয়ে একনাগাড়ে ছবি তুলে চলি। বিচিত্র এক প্রাকৃতিক ফুল শিউলি, যাকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় পারিজাত ও শেফালিকা। হিন্দিতে শিউলিকে বলা হয় হরসিঙ্গার।
বাংলায় যার নাম শিউলি এবং শেফালি। উদ্ভিদবিজ্ঞানীয় নাম নাইকসানথেসো আবাথ্রেসটিসা। শিউলিকে ইংরেজিতে বলা হয় নাইট জেসমিন, ট্রি অব সরো, কুইন অব দ্য নাইট এবং কোরাল জেসমিন। শরৎকালে বাতাসে শিউলি ফুল শীতল পরশ বয়ে আনে, সঙ্গে বাতাসে সুবাস। শিউলির সে গন্ধে আছে øিগ্ধ শুদ্ধ ভাব. যা পূজার জন্য মনকে তৈরি করে। শিউলি ফোটার মধ্য দিয়েই হিন্দু সম্প্রদায়ের মহোৎসব দুর্গাপূজার সূচনা হয়। এক সময় ঢাকা থেকে শিউলি ফুলের রঙ বিদেশে রফতানি করা হতো। এখন আর রঙ ঢাকা থেকে বিদেশে রফতানি হয় না। আগের মতো শিউলি ফুলও এখন আর নেই এই নগরে।
কাশবনের গ্রামে শরতে বেজে ওঠে শারদীয় দূর্গাপুজার ঢাকঢোল। বাঙালির হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব দূর্গাপুজার আনন্দ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। পুজার শেষে ব্রহ্মপুত্র নদে বিসর্জন দেয়া হয় শারদীয় দূর্গা দেবীকে। এভাবে অসূরের বিরুদ্ধে বিজয়ী দেবী প্রকৃতিকে সূচী শুভ্র করে মর্ত্য থেকে বিদায় নেয়। আমাদের কাশবনের কাব্যে সময় দ্রুত গড়িয়ে যায়। অবশেষে নির্জনতা থেকে কোলাহলে ফিরে আসার আয়োজন শুরু হয়।