মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম >>
কমরেড মনোরমা বসু মাসীমার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, লাল সালাম
সমাজ সেবক,স্বদেশী আন্দোলন,সাম্যবাদী আন্দোলনে লড়াকু নেত্রী মনোরমা বসু মাসীমা ১৮৯৭ইং সালের ১৮ নভেম্বর বরিশাল জেলার বানারীপাড়ায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।
মাত্র এগারো বছর বয়সে ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। চৌদ্দ বছর বয়সে বরিশালের বাঁকাই গ্রামের জমিদার চিন্তাহরণ বসুর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় এবং স্বামীর প্রত্যক্ষ সমর্থনে তিনি স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। জমিদার বাড়ির রক্ষণশীলতা ও বিধিনিষেধ অতিক্রম করে তিনি মুক্ত জীবনে প্রবেশ করেন। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে তিনি জমিদার বাড়ি ছেড়ে বরিশালে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন।
বরিশালে অবস্থানকালে মনোরমা স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং নারী অধিকার রক্ষায় ‘সরোজনলিনী মহিলা সমিতি’র শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশে এটিই ছিল প্রথম মহিলা সংগঠন। এ সমিতির মাধ্যমেই তিনি নারী সমাজকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৩০ সালে তিনি কংগ্রেস মহিলা কর্মী হন এবং ১৯৩২ সালে কংগ্রেসের ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন।
তিনি অনাথ ও দুঃস্থ মহিলাদের, বিশেষ করে বিধবা ও কুমারী মেয়েদের আশ্রয় দানের জন্য বরিশালের কাউনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘মাতৃমন্দির আশ্রম’। আজীবন তিনি এটি পরিচালনা করেন। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। তিনি ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র বরিশাল জেলা শাখার অন্যতম নেত্রী ছিলেন। ১৯৪৩-৪৪ সালে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর সময় লঙ্গরখানা, চিকিৎসালয় ও উদ্ধার আশ্রম স্থাপন এবং পুনর্বাসন কাজে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া বরিশাল জেলার বিভিন্ন নারী আন্দোলন, সমাজসেবা ও রাজনৈতিক কাজের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বরিশাল জেলা শাখা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি নারীমুক্তি আন্দোলনকে গতিশীল করেন।মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ পরিষদের সহসভানেত্রী ছিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নতুন শাসকদের শাসন ও শোষণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালে বরিশালের খাদ্য-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তিনি এক বছর সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করেন এবং সে সঙ্গে জননিরাপত্তা আইনে আরও তিন বছর কারাভোগের পর ১৯৫২ সালের ২৫ এপ্রিল মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে মনোরমা বসু আত্মগোপন করেন এবং সে অবস্থা থেকে আত্মপ্রকাশের পর তিনি ‘মাতৃমন্দির আশ্রম’-এর কাজে ব্যস্ত থাকেন। একই সঙ্গে গড়ে তোলেন আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লি কল্যাণ অমৃত পাঠাগার ও শিশুদের জন্য মুকুল মিলন খেলাঘর।
১৯৬২ ও ৬৪’র গণআন্দোলন এবং ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মহিলাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। দেশপ্রেম, সমাজসেবা ও মানুষের প্রতি ভালবাসার কারণে দলমত-নির্বিশেষে সকলে তাঁকে ‘মাসীমা’ বলে ডাকত। তিনি ছিলেন সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত এবং যেকোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চারকণ্ঠ। তাঁর জীবদ্দশাতেই সত্যেন সেনের ‘মনোরমা মাসীমা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
১৯৮৬ ইং সালের ১৬ অক্টোবর তিনি না ফেরার দেশে চলে যান।তাঁর আদর্শের লড়াই আজও চলছে,স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা,লাল সালাম।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি। নোট: লেখাটি লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া।