এ বছর আমি অনেক কষ্টে স্কুলের গণ্ডি পেরুলাম। আমার এমন করুণ দশা দেখে অনেকেই অবাক। ধুলোময় রাস্তায় হেঁটে হেঁটে আজ বারবার মনে হচ্ছে, বাবা বেঁচে থাকলে হয়ত এমনটা কখনই হত না। যে গতিময় জীবন ভীষণ উজ্জ্বল আর সম্ভবনাময় হবার কথা ছিল, সে জীবন এখন প্রায়ই হতাশায় ডুবে যায়।
মা আজ বাড়ি নেই। আজকাল প্রায়ই সে বাড়ি থাকে না। বিভিন্ন কাজে এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়। তবে কিছু ধান আনতে দাদা বাড়ি যাবার কথা আজ । বাবার কেনা কিছু জমির ফসল আত্মীয়-স্বজনদের হাত ছাড়িয়ে, আমাদের বাড়ি পর্যন্ত আনতে মায়ের মাঝে মাঝে হাঁফ ধরে যায়। তবুও সে হাল ছাড়ে না। গত কিছু বছর আগেও যে জীবন খুব ঠিকঠাক চলছিল, আচমকা ঝড়ে সব পাল্টে গেল।
মা’ র জন্য সবসময় এক ধরনের অস্বস্তি হয় আমার। খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয় তার। এই হালকা গড়নের শ্যামলা, মিষ্টি মেয়েটাই ছিল বাবার প্রথম প্রেম। মা তখনও স্কুলের গণ্ডি পেরুয়নি। একদিন নানা মাকে পড়ানোর জন্য বাবাকে রেখে দিলেন। তাই দুপুর গড়ালেই বাবা এসে প্রতিদিন হাজির হয়। কিন্তু মাকে দেখা মাত্রই কেন যেন বাবা তার বুকের ভিতর পেয়ালা পিরিচ ভাঙ্গার শব্দ পায়! এ এক আজব ব্যাপার বটে! এদিকে মায়ের পড়াশুনায় তেমন মন নেই, ভাবখানা এমন যে কোন রকম স্কুলের গণ্ডি পেরুলেই হয়। কিন্তু বাবাকে দেখলেই যে মায়ের মেজাজ বিগড়ে যায়, পড়তে ইচ্ছে হয় না। নানার উপর খুব রাগ হয় মায়ের, কোন রুচি নেই নানার। এমন কালো, মোটাসোটা মানুষকে কেউ টিউটর রাখে! বাবা হাসলে চোখ দুটো সরু হয়ে লেগে গিয়ে ঝকঝকে দাঁতের পাটি বের হয়ে যায়। এটা মায়ের পছন্দ নয়।
এখন প্রায় প্রতি বিকেলেই বাবাকে মায়ের সহ্য করতে হয়। এমনিতেই পড়াশুনায় মন নেই, তার উপর চোখের সামনে অমন অপছন্দের, নিরীহ তরুণ! অসহ্য লাগে সবকিছু। ঘরের বারান্দায় প্রতিদিন নানা চেয়ারের পেছনে মাথা হেলিয়ে খবরের কাগজে চোখ বুলায়, তাই তার চোখকে কোন রকম ফাঁকি দেবারও সুযোগ নেই। প্রতিদিন এই নিরীহ মানুষের সামনে পড়তে বসতে বসতে, মা একদিন তার ভিতর এক লোমহর্ষকর অনুভূতি টের পায়। কিন্তু এই অনুভূতির নামকরণ সে করতে পারে না। অসহ্য লাগা মানুষটাকে তার ধীরে ধীরে সহ্য হতে থাকে।
ঝুঁকে পড়া পড়ন্ত বিকেলে বাবার বিষণ্ণ চোখ দেখলে মায়ের আজকাল খুব মায়া হয়। আগে যদিও এমনটা হত না। তবে ইদানীং খুব হচ্ছে। আর কেনই বা হচ্ছে তাও সে জানে না। প্রতি বিকেলে মায়ের সামনে অহংকারে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা মানুষটা আসলে তেমন অহংকারী নয়, যতখানি তাকে ভাবা হয়। মায়ের মুখোমুখি বসে থাকা বাবার এক জোড়া নিথর চোখে মায়ের চোখ পড়তেই, বাবা খুব দ্রুত গতিতে তার চোখ সরিয়ে নেয়। কিন্তু এসব দেখে মায়ের বারবার কেন যেন মনে হয়, এ যেন নদীর পাড়ে নিরবে, নিভৃতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই যুবকের ছায়া, যে ছায়া মনের নদীতে কেঁপে কেঁপে ভেঙে যায়। মা সব টের পায় কিন্তু কিছু বলে না। বাবাও বরাবর নিশচুপ। তবে কি বাবা এসবের কিছু টের পায়? তা মনে হয় না।
বাবা খুব শান্ত আর নিরীহ বটে, তবে বেজায় মেধাবী। প্রথমবার কেউ দেখলে তাকে তেমন পাত্তা দেয় না। কারো নজরে পড়ার মত তার কোন আলাদা চাকচিক্য নেই। মা ভেবে পায় না, কী দেখে নানা বাবাকে এত পছন্দ করে? নিরীহ বলে নাকি মেধাবী বলে, কে জানে? পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বাবা মাঝে মাঝে মাকে শান্ত চোখে দেখে। বিকেলের শেষ আলোয় পিঠ ছাড়িয়ে যাওয়া কালো মসৃণ চুলের নিচে মায়ের মিষ্টি মুখখানা দেখতে বাবার বেশ লাগে। মায়ের নতমুখে কানের দুল বাতাসে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত বাবার চোখের সামনে দুলতে থাকে। মায়ের চোখে চোখ পড়তেই বাবা তার চোখ সরিয়ে নেয়। মাকে দেখলেই ভিতরে সে প্রতিবার কাপ পিরিচ ভাঙার শব্দ পায়। শব্দটা মাঝে মাঝে এতো বেশি হয় যে বাবার ভয় হয়, পাছে মা বুঝি কিছু বুঝে ফেলে!
এদিকে নানা একদিন কী মনে করে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে হাজির। গাঁয়ের মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, বাবার সম্পর্কে সব তথ্য উপাত্ত নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। এখন সুযোগ পেলেই নানা বাবার গাঁয়ে ঢুঁ মারেন। গাঁয়ের এবড়ো থেবড়ো জমির আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে, নানার কেবল মনে হয় এই গ্রামে মাকে বিয়ে দিলে মায়ের কষ্ট হতে পারে। তবে এত ভাল ছেলেকেও তো হাতছাড়া করা যায় না। তাই জমি কেনার নাম ধরে নানা বাবার গ্রামে প্রায়েই যাতায়াত করেন ।
আজ কদিন ধরে বাবা মাকে পড়াতে আসছে না। কী হল বাবার? অসুখ, নাকি আর পড়াতে আসবে না? এই ভেবে মায়ের প্রতিটি বিকেল খুন হয়। বইয়ের পাতায় বাবার হাতের ছাপ, হাতের লেখা দেখলেই কেমন জানি সবকিছু শূন্য লাগে। বড্ড বেশি একা লাগে। এমন শান্ত, লাজুক একটা মেয়ের কেন হঠাৎ এমন হচ্ছে, তা সে নিজেও জানে না । বেশ কয়েকদিন অপেক্ষা করে, মা নানাকে একদিন বাবার কদিন ধরে পড়াতে না আসার কারণ জানতে চায়। নানা তখনেই ভিতরে ভিতরে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। নানা জানে, মায়ের পড়াশোনায় একেবারেই মন নেই, না পড়তে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তবে কি… !
এর কিছুদিন পর মায়ের বিবর্ণ বিকেল রঙিন করে দিয়ে এক বিকেলে বাবা এসে হাজির। মুখে বরাবরের মত কোন হাসি নেই, পরনে কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট এর হাতাগুলো কনুইয়ের দিকে ভাঁজ করা। বাঁ হাতের ঘন লোমের উপর বাবার কালো রঙের ঘড়িটা হাতের কব্জি জড়িয়ে ধরে আটকে আছে। মাকে দেখে আবারও বুকের ভিতর সেই কাপ পিরিচ ভাঙার শব্দ! আজ শব্দটা একটু জোরে হল মনে হল। এ কয়েকদিন মাকে না দেখে বাবারও যে খুব অস্থির সময় কেটেছে। বাড়ির একটা জরুরি কাজে হঠাৎ আটকে গিয়েছিল। মাকে ভালবাসার কথা বলতে তার সাহস হয় না। বড়লোক বাবার আদুরে মেয়ে, জন্মের পর থেকে অভাবের ছিটেফোঁটা যে দেখেনি, তাকে ভালবাসার কথা জানানোর জন্য যে সাহস দরকার, তা তার নেই। সে যে বড় নিরীহ মানুষ।
এদিকে নানা খুব বিচক্ষণ লোক। চোখ দেখেই যে চোখের ভাষা পড়ে নিতে পারে। সে এতো দিন খুব যত্ন করে পাকা চোখে দুজনকে খেয়াল করেছে। এবার কাজে নামার পালা। একদিন দাদা বাড়িতে গিয়ে, প্রচলিত সামাজিক প্রথা ভেঙে নানা নিজেই মায়ের জন্য বাবাকে চেয়ে প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। নানার যে সামাজিক মর্যাদা আর অবস্থান, তাতে কোন দিক থেকেই এই বিয়ের প্রস্তাবকে এড়ানো যায় না। আর বাবার কাছে এ প্রস্তাব ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখময় ঘটনা!
এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় বাবার বাড়িতে মা যখন প্রথম বউ সেজে গেল, মায়ের কখনও মনে হয়নি বাবা খুব চুপচাপ আর নিরীহ গোছের মানুষ। মাকে বউ করে পেয়ে বাবার মন আনন্দে ছটফটে চঞ্চল হয়ে উঠল। মাকে কাছে পাবার জন্য দরজার খিলে বাবার আঙুলের অস্থিরতা মাকে ভিতরে ভিতরে সুখের বন্যায় ভাসিয়ে দিত। মা একসময় ভুলেই গিয়েছিল যে, এখন সে সাধারণ গাঁয়ের সহজ সরল এক পরিবারের বউ। বাবা আর তার পরিবারের ভালবাসায় তার সুখ যেন উপচে পড়ত।
বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর বাবা যখন কাজ নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেলেন, তখন মাকে আমাদের নানা বাড়ি নিয়ে এলেন । সেই থেকে নানা বাড়িতেই আমাদের শৈশব শুরু। আমরা চার ভাই বোনের মধ্যে তিন জনই স্কুলের পাঠ শুরু করেছি। বড় আপা ততদিনে স্কুল ছাড়িয়ে গেছে। বাবা প্রতি সপ্তাহে একটা করে মাকে চিঠি লিখেন। তবে তা আসলে চিঠি কি না তা বলা যায় না, কারণ চিঠির দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে থাকে আমাদের চার ভাইবোনের প্রতি সপ্তাহের পড়া! আমরা কে কখন এবং ঠিক কোন সময় কি শ্রুতলিপি লিখব, তা সব কিছু চিঠিতে তারিখ আর সময় দিয়ে লিখা থাকে। দুপুরের খাবার পরেই মা আমাদের ঝকঝকে লাল মেঝের বারান্দায় কালো শ্লেট আর চক দিয়ে শ্রুতলিপি লিখাতে বসাতেন যেন আমাদের হাতের লিখা সুন্দর হয়। প্রতিদিনের চর্চায় আমাদের হাতের লেখা সত্যি খুব সুন্দর হয়ে উঠল। যতদিন তেমন করে ফোন এর ব্যবহার শুরু হয়নি, ততদিন এভাবেই চিঠির মাধ্যমে বাবা মায়ের যোগাযোগ হত। যেহেতু বাবা সব কিছুর দায়িত্ব নিয়েছেন, তাই মায়ের তেমন কোন কাজ ছিল না, কেবল আমাদের দেখাশুনা ছাড়া।
প্রতি বছর বাবা একবার করে বিদেশ থেকে বাড়ি আসতেন। বাবাকে অনেক দিন চোখে না দেখার কারণে প্রথম একটু অস্বস্তি হত, তবে কিছুক্ষণ পর যেন সব ঠিক হয়ে যেত। এ যেন কোন কিছু দিয়ে পানির মত রক্তে আঘাত করার মত, কিছু মুহূর্ত আঘাতের ফলে পানি সরে গিয়ে আবার পানি এক হয়ে যায়। যতদিন বাবা বাড়ি থাকতেন, ততদিন খেলার সাথীদের চেহারা দেখা হত না । বাবার ভয়ে বন্ধুরাও বাড়ির আশেপাশে আনাগোনা করে, আমাদের না পেয়ে চলে যেত। আমাদের সঙ্গে বাবা প্রতি মুহূর্ত কাটাতে চাইত, কারণ বছরের অন্য সময় সে আমাদের চোখে হারাত বলে। বাবার কাছে পড়াশুনাটা ছিল সবার উপরে। এটা ঠিক থাকলে আমাদের জন্য কোন কিছুর কমতি হত না। দেশে আসার পর মায়ের গলায় চকচক করত দামি সোনার চেইন ,আর আমাদের জন্য দামি সব খেলনা।
নানা বাড়িতে আমরা থাকতাম ঠিকই, তবে আমাদের যাবতীয় সব খরচ বাবাই বহন করত। জীবন খুব মসৃণভাবে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন চকচকে রোদেলা দুপুরে বাবার এক বন্ধু ফোন করে বাবার মৃত্যুর খবরটা দিলেন! কাজ থেকে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা যান। সেদিন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘরে শোকে পাথর হওয়া মায়ের হাতে বাবার দেয়া রঙিন তসবি যেন মায়ের আঙুলের ফাঁকে ভারী পাথরের মত মনে হল।
সেইদিন থেকে আমাদের জীবন নতুন করে বাঁক নিতে শুরু করল। নানা বাড়ির ঝকঝকে বারান্দায় ঠিক আগের মতই এখনও আলো এসে পড়ে, কিন্তু আমাদের আর আগের মত পড়তে বসা হয় না। এদিকে কিছু সময়ের ব্যবধানের পর সব মামারা বিয়ে করায়, মা নানা বাড়ি ছেড়ে, বাবার করে যাওয়া বাড়িতে উঠে গেলেন। এর কয়েক বছর পর নানা মারা যান। এরপর আমাদের জীবনের রঙ নানাভাবে বদলাতে শুরু করে।
নানার রেখে যাওয়া অনেক সম্পত্তি যেহেতু কোন ভাগ বাটোয়ারা হয়নি, তাই মায়ের অংশ মা তখনও পায়নি। ততদিনে আমাদের অনেক অর্থকষ্টে পড়তে হয়। বাবার রেখে যাওয়া বাড়ি ছাড়া আমাদের আর তেমন কিছু নেই। মায়ের যত স্বর্ণ ছিল, তা বিক্রি করে বাড়ির অসমাপ্ত কাজ শেষ করা হয়েছে। বাড়িসুদ্ধ মানুষ, তাদের বায়না আর খোরাকি এখন মা এদিক ওদিক করে, একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।
বাবা মারা যাবার পর থেকেই মায়ের মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। অল্পতেই রেগে যায়। মুখে যতটুকু হাসি ফোটে, তাকেও যেন নকল মনে হয়। মা জানে, রাগ নেতিবাচক আবেগ, তবে বাবাকে হারিয়ে জীবনের অনেক বড় শূন্যস্থানই এই রাগের জন্ম দিয়েছে ।
আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি। থামবার নাম নেই। বৃষ্টি হলে বাড়ির সামনে কাদা পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। চারপাশ দেখলে গা ঘিনঘিন করে ওঠে। আমাদের রান্নাঘর মূল ঘর থেকে কয়েক কদমের পথ। বৃষ্টির দিন কাদা মাটি মাড়িয়ে মায়ের রান্নাঘরে যাওয়া অনেক কষ্ট হয়ে যায়। রান্নাঘরেরও নাজেহাল অবস্থা। টিনের ছাউনির নিচ দিয়ে আকাশ দেখা যায়। বৃষ্টি বাদলে মায়ের রান্না সারতে প্রায় যুদ্ধ করতে হয়।
বেশ কদিন যাবত মায়ের চেহারাটা মলিন। তবে এর কিছুটা কারণও রয়েছে। কিছুদিন হল ছোট চাচা সদ্য বিয়ে করলেন। বিয়েতে মাকে আমন্ত্রণ জানালেও ঝামেলাটা বাঁধল গায়ে হলুদের দিন। মাকে পাড়ার কিছু মানুষ ছোট চাচার গায়ে হলুদ দিতে বারণ করলেন বিধবা হবার কারণে। এতে নাকি নতুন বর কনের অমঙ্গল হতে পারে। এরপর থেকে মায়ের মন খারাপের আড়ালে, মায়ের চাপা কান্নাটা একবারের জন্যেও আমার চোখ এড়ায়নি। এই সমাজে বিধবা হওয়াও যে এক ধরণের অপরাধ, মা বিধবা না হলে বুঝতেই পারতাম না। জীবনে কত কষ্ট যে তাকে সহ্য করে চলতে হয়, আর তার সব চাহিদা জলে ডুবিয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সারাজীবন পার করতে হয়, এ কেবল বিধবারাই জানে।
এদিকে বড় আপা হঠাৎ একদিন একজনকে পালিয়ে বিয়ে করে বসল। প্রেম তো অপরাধ নয়, কিন্তু পালিয়ে বিয়ে করাটা মা ঠিক মেনে নিতে পারেনি। বড় আপার বিয়ের পর আমাদের সদস্য সংখ্যা একজন কমে চারজন হল। আমাদের প্রতিদিনকার খরচ মেটাতে মায়ের হিমশিম অবস্থা। নানার এত সম্পত্তি, অথচ এর এখনও কোন ভাগ বাটোয়ারা হয়নি, হলে আমাদের জন্য খুব ভাল হত।
মায়ের আগের সেই হাসিমুখ আর নেই। আধাপাকা চুলে মেহেদির ছাপের নিচে চেহারার মলিনতা স্পষ্ট বুঝা যায়। আগে বাবা যখন বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরতেন, মায়ের চোখে মুখে হাসি উপচে পড়ত। বিদেশ থেকে আনা বাবার স্বর্ণের কানের দুল আর গলার চেইন মায়ের হাসির মতই আলোর মত ঝলসে উঠত। বাবার ফিরার আনন্দে উঠোন জুড়ে মায়ের ছুটাছুটি, উঠোনের রোদে বাবার জন্য বানিয়ে রাখা পিঠা, রোদের আলোয় হেসে উঠা মায়ের হাতের চুড়ি, এ সবই এখন স্মৃতি।
আমাদের বাড়িটাকে আজকাল খুব মলিন মনে হয়। আলো-বাতাস না থাকায় ঘরে সবসময় একটা আবছা আলো লেগে থাকে। এমন পরিবেশে মনে বিষণ্ণতা আরও চেপে বসে। সামনে এক চিলতে উঠোন। একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। বাড়ির দুপাশে টিন দিয়ে দুই চালাঘর বানানো হয়েছে। যা ভাড়া আসে তাতে সংসারের অনেকটা কাজ হয় , অন্তত আমাদের পড়ার খরচটা কিছুটা চলে যায়।
জীবন কখনও কখনও গিরগিটির মত রঙ বদলায়। আগে যেখানে প্রতিদিন সোনাঝরা দুপুরের খাবারের পর ঝকঝকে বারান্দায় মাদুরের কোলে, কালো শ্লেটের উপর সাদা চক দিয়ে ভাইবোনদের সুন্দর হস্তাক্ষর ছিল আমাদের সুন্দর জীবনের মতই ঝকঝকে সুন্দর, সে দিন এখন বদলেছে।
আজ অনেকদিন হল বাংলা মদ খাই না, খেলে গা গুলিয়ে বমি আসে। আগে কার সঙ্গে মিশতাম, তা নিয়ে বাবা আর মায়ের ছিল কড়া নজর। জীবনের কড়া নজরজারিতে মাঝে মাঝে হাঁফ ধরে আসত। বারবার মনে হত, এত নিয়মে চলতে পারে মানুষের জীবন? কোন স্বাধীনতা নেই, কোন রঙ নেই, স্বাদ নেই। নিজের মত করে বাঁচা যায় না, অনেক কিছু করা যায় না। এখন সে দিন আর নেই। বাবা নেই, তাই শাসনও নেই, মায়ের আগের মত নজরদারি নেই, তাই নিজের ইচ্ছে মত চলা যায়।
একসময় বাবা স্বপ্ন দেখতেন তার ছেলেমেয়ে খুব বড় হবে। আমরা বড় হচ্ছি সত্যি, কেবল বাবার স্বপ্নটা বড় হতে পারেনি। আমার আঙুলের ফাঁকে সিগারেট, বাতাসে বিষণ্ণ ধোঁয়া, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বখাটেদের সঙ্গে উঠাবসা। মেয়েদের স্কুল কলেজের সামনে আমার নিয়মিত যাতায়াত। কখনও সিগারেটের ধোঁয়ার ফাঁকে মেয়েদের নজরকাড়া শরীর। এ সবই এখন আমার প্রতিদিনকার কাজ।
বাবা মারা যাবার পর জীবন নৌকা তার বৈঠা হারিয়েছে। এখন কেবল জীবনের স্বাভাবিক স্রোতে যতখানি ভেসে বেড়ানো যায়। সবকিছুই তো আমাদের ঠিকঠাক ছিল, কেবল ভাগ্যটা মাঝপথে বিগড়ে গেল। জীবন গাড়ির মত জীবনপথে বাঁক নিয়ে ঘুরে গেছে। প্রতিদিন মায়ের অলস ক্লান্ত চোখে শব্দহীনভাবে শেষ হয়ে যায় আমাদের প্রতিটি দিন। উজ্জ্বল হবার দিনগুলো রঙহীন, স্বাদহীন হয়ে ফুরিয়ে যায় আমাদের। আমাদের কোন নিয়ম নেই, কেউ আমাদের বাঁধা দেয় না, কেউ ভুল ধরে না। এক আজব নিয়মে আমাদের জীবন চলে। ভাগ্য দাবার ছকের মত জীবন ছক থেকে মন্ত্রীকে সরিয়ে নিয়েছে। তাই এক রানী নিয়ে জিততে পারাটা খানিক কষ্টের। অপরাহ্ণের নিঃশেষ হওয়া আলোয় বাড়ির সিঁড়িতে বসে মায়ের চোখের বিষণ্ণ ছায়াতে বাবার অভাব তাই প্রতিনিয়ত অনুভূত হয়। ভাগ্য পৃথিবীর অনেক কিছুর মত রঙ বদলায় বলে, রঙিন হতে না পারার কষ্ট জীবনভর থেকেই যায়।
আলিফ আলম : গল্পকার, কানাডা।